দ্রুত নির্বাচনের লড়াইয়ে একা বিএনপি : সরকার সম্ভাব্য সময় বললেও দিচ্ছে না পথনকশা
দ্রুত সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপি একাই চালিয়ে যাচ্ছে লড়াই। শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অন্য যেসব দল ও পক্ষ ছিল, তাদের বেশির ভাগের অগ্রাধিকারে রয়েছে সংস্কার ও গণহত্যার বিচার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের যে সম্ভাব্য সময়ের কথা জানিয়েছেন, এতে অন্যরা স্বাগত জানালেও বিএনপি বলছে, অস্পষ্টতা কাটেনি।
নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটানো ছাত্র নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের বিচারের আগে নির্বাচন হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনেরও অগ্রাধিকারে রয়েছে সংস্কার। যেসব দল বিএনপির কাছ থেকে আগামী নির্বাচনে আসন ছাড় পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তারাই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। অন্যরা দিচ্ছে না তাড়া।
বারবার তাগাদা দিলেও বিএনপি নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে সময়সীমা বেঁধে দেয়নি। বিএনপি কেন নির্বাচনের জন্য তাড়া দিচ্ছে, এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত বুধবার তিনি বলেছেন, ‘অনেকে বলেন, আমরা শুধু ভোটের কথা বলি। আমরা রাজনীতি করি। আমরা ভোটের কথা বলব, এটাই স্বাভাবিক।’
রাজনৈতিক সূত্রগুলোর ভাষ্য, নির্বাচনে নিশ্চিত জয়ের সম্ভাবনা এবং পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কাতেই বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। অন্য দলগুলোর এককভাবে জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই ভোটের জন্য তাড়াহুড়াও কম।
গতকাল দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের ব্রিফিংয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখছি না। আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা এবার নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবেন। তিনি তা দেননি। এটি আমাদের হতাশ করেছে।’
সংস্কারে গুরুত্ব দেওয়া জামায়াত নির্বাচনের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময়ের কথা বলছে। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, ‘আমাদের সবার দাবি সংস্কার হোক, তারপর নির্বাচন। আমাদের বলতে বোঝাচ্ছি, আমরা যারা এতদিন নির্বাচনের জন্য লড়াই করেছি। কেউ একটু আগে চায়, কেউ একটু পরে। পার্থক্য তো এতটুকুই। এত বছর আন্দোলন হয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, ভোটাধিকারের জন্য। তা ঠিক করতে, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে, অন্যান্য সংস্কার তো আছেই।’ ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন যৌক্তিক সময় কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি অনেকেই সমর্থন করছে না। আবার জামায়াত বলছে না, এটাই হতে হবে। নির্বাচনের জন্য তড়িঘড়িও দরকার নেই, বিলম্বেরও দরকার নেই।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সমকালকে বলেন, ‘আগে জুলাই গণহত্যা ও শেখ হাসিনার বিচার, পরে নির্বাচন হতে হবে। আওয়ামী লীগের বিচার এবং সংস্কার দৃশ্যমান হতে হবে। নিশ্চয়তা চাই, বিচার ও সংস্কার হবে। সব সংস্কার ইউনূস সরকার করতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার তো হতে হবে।’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, বিএনপি কি সংস্কার ও বিচারের আগেই নির্বাচন চায়?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব।’
রাজনৈতিক সূত্র বলছে, অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালানো এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়ায় আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিজয় একরকম নিশ্চিত। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভোটের পরিসংখ্যানও বিএনপির পক্ষে। সারাদেশে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামো থাকায়, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে বিএনপির একচেটিয়া জয় সম্ভব। এ কারণেই দলটি দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিচ্ছে।
ছাত্র নেতৃত্ব রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেও মাঠ পর্যায়ে খুব বেশি সাড়া নেই। তাদের দুই সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থানা, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে কমিটি করলেও ওয়ার্ড, ইউনিয়নে সংগঠন বিস্তার করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন পেলেও দল গঠনের পর মাঠ গুছিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থায় যেতে পারবে কিনা, তাও নিশ্চিত নয়।
হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানে জামায়াতের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ থাকলেও নির্বাচনের অতীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ দলটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পাওয়াই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত তার সেরা সাফল্য পায়। সেবার ১২ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮ আসন পেয়েছিল। পরের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোতেও ভোট কমে দলটির।
বড় মিছিল-সমাবেশ করে আলোচনা থাকলেও ইসলামী আন্দোলন কখনও সংসদে যেতে পারেনি। খেলাফত মজলিসের দুই অংশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ অভ্যুত্থানের শরিক অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোরও নির্বাচনী সাফল্য সামান্য। জাতীয় পার্টি (জাপা) ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩২ আসন পেলেও পরের নির্বাচনগুলোতে দলটির ভোট কমেছে। গত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে অংশ নেওয়ায় স্বৈরাচারের তকমা পাওয়া জাপা রংপুরের কয়েকটি আসন ছাড়া কোথাও জেতার মতো অবস্থায় নেই। সিপিবি, বাসদসহ বাম দলগুলো ১৯৯১ সালের পর কখনও জামানত বাঁচাতে পারেনি।
দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদের একাংশ, ১২ দলীয় জোট, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিএনপির সঙ্গে রয়েছে। তাদের আসন ছাড়ার আভাস দিয়েছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ছয়টি আসনে সহায়তাও দিচ্ছে।
এর বাইরে থাকা সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের অপরাংশের জন্য আগামী নির্বাচন হবে প্রথম ভোট। ছাত্র নেতৃত্বেরও ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দল দুটি বক্তৃতা-বিবৃতিতে রাজনীতিতে আলোচিত হলেও সাংগঠনিক শক্তিতে দুর্বল।
১৬ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে জানিয়েছিলেন, অল্প সংস্কার হলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কারে আরও ছয় মাস অতিরিক্ত লাগতে পারে। ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে বলে আভাস দিয়েছিলেন তিনি। পরের দিন তাঁর প্রেস সচিব জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। অন্যরা স্বাগত জানালেও এ বক্তব্য যৌক্তিক নয় বলে প্রকাশ্যেই জানিয়েছে বিএনপি।
দ্রুত নির্বাচন চাইলেও কতদিনের মধ্যে ভোট চায়, তা বলছে না বিএনপি। সূত্র জানায়, দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছে ছয় মাসের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। কমিটির এক সদস্য সমকালকে বলেন, অন্যদের নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা নেই। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে কিছুটা ক্ষমতা পেয়েছে। নির্বাচন হয়ে গেলে তা থাকবে না, এ কারণেই ভোট চায় না। ছাত্রনেতৃত্বের মধ্যেও একই ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আবার উপদেষ্টা পরিষদও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাইছে।
যদিও অন্য দলগুলোর মূল্যায়ন ভিন্ন। তাদের ভাষ্য, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ‘সুপার মেজরিটি’ পেয়ে ক্ষমতা পেলে তারাও শেখ হাসিনা কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারে। জামায়াতের এক নেতা সমকালকে বলেন, ড. ইউনূসের নেতৃতেই রাষ্ট্র সংস্কার সম্পন্ন হতে হবে। রাজনৈতিক সরকার নিজের ক্ষমতা কমাবে না।
বিপরীতে বিএনপি নেতাদের শঙ্কা, বর্তমান সরকার অর্থনীতিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে, এর দায় নিতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে পতিত আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। আবার ৫ আগস্টের পর নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, দখলের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় বিএনপির জনসমর্থন কমতে পারে। এসব আশঙ্কায় বিএনপি নির্বাচনে সময়ক্ষেপণের বিরোধী।
গত বুধবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটিতে ড. ইউনূসের ভাষণ এবং প্রেস সচিবের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটি লিখিত বক্তব্যে জানায়, ড. ইউনূসের ভাষণে নির্বাচনবিষয়ক বক্তব্য অস্পষ্ট। তাঁর বক্তব্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় বলা হলেও পথনকশা নেই।
স্থায়ী কমিটির সভা থেকে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের প্রথম অংশে নির্বাচনের কথা বলেছেন, যা অস্পষ্ট। তাঁর প্রেস সচিব বলেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, যা পরস্পরবিরোধী। স্থায়ী কমিটি মনে করে, এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তাদের দেওয়া বক্তব্য কোনটা সঠিক, আমরা বুঝতে পারছি না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, স্থায়ী কমিটি মনে করে, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত ভোট সম্ভব। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com