যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : কেন হার কমলার, কোন মন্ত্রে ট্রাম্পের জয়
একাধিক মামলা নিয়ে আদালতে দৌড়ঝাঁপ, দু’বার হত্যাচেষ্টার শিকার হওয়াসহ নানা চাপ নিয়ে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। হেরে গেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। তাদের এই জয়-পরাজয়ের পেছনের প্রকৃত কারণ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। প্রশ্ন উঠছে, ট্রাম্পের বিরল বিজয়ের পেছনে মুখ্য ভূমিকায় ছিল কী; কেনইবা হেরে গেলেন কমলা হ্যারিস?
বিশ্লেষকরা কয়েকটি বিষয়কে তাদের জয়-পরাজয়ের মানদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে– মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন, ডেমোক্র্যাটবিমুখ আরব-মার্কিনি ভোটার ও নারী-পুরুষ বৈষম্যের মতো বিষয়।
বিবিসির বিশ্লেষণে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মার্কিন অর্থনৈতিক অবস্থাকে। দেশটিতে বেকারত্ব বেড়েছে। অধিকাংশ মার্কিনি মনে করেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অর্থনীতিই ছিল ভোটারদের মূল উদ্বেগের কারণ। মহামারি-উত্তর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০-এর দশকের পর সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি সমস্যা দেখা দেয়। ফরেন পলিসির কলামিস্ট মাইকেল হির্স টক বলেন, জো বাইডেনের ব্যয়বহুল কর্মসূচির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল, যা কমলার পথকে কঠিন করে তুলেছে। ট্রাম্প আশ্বাস দিয়েছেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ওপর তিনি পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়াবেন। সিএনএনের এক জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি মার্কিন ভোটার অর্থনৈতিক ইস্যুতে কমলার চেয়ে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন।
কমলার হারের পেছনে জো বাইডেনের অজনপ্রিয়তাকেও দায়ী করা হচ্ছে। মেয়াদের শেষ দিকে তাঁর অনুমোদন হার অনেকটাই কমে গিয়েছিল। বাইডেন প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ায় এর দায় বর্তেছে কমলার ওপর। তাছাড়া কমলা ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কীভাবে তিনি জো বাইডেনের চেয়ে আলাদা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডেমোক্রেটিক পার্টি ‘ভাবমূর্তি সংকটে’ রয়েছে। তাদের নতুন করে শুরু করতে হবে।
গর্ভপাত ও অভিবাসন ইস্যুতে রিপাবলিকানরা সুবিধা পেয়েছে। ট্রাম্প অভিবাসন নিয়ে কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছেন; পাশাপাশি সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়েও তিনি সোচ্চার ছিলেন। এটা বিপুল সংখ্যক শ্বেতাঙ্গ মার্কিনিকে আকৃষ্ট করেছে। পিউ রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, জো বাইডেনের সময়ে সীমান্ত দিয়ে অভিবাসীদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা ছিল অনেক বেশি। তবে গর্ভপাত নিয়ে কমলার আশ্বাসে নারীদের বেশি সমর্থন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা যথেষ্ট ছিল না।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির হোভার ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো ব্রিটিশ-মার্কিন ঐতিহাসিক নিয়াল ফার্গুসন বলেন, গত চার বছর ধরে চলা বাইডেন প্রশাসনের নীতিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতে মার্কিনিরা ভোট দিয়েছেন। ট্রাম্প বৈধতার নথিপত্র ছাড়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের দেশছাড়া করার ঘোষণাও দেন, যা মার্কিন অভিবাসনবিরোধীরা ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন।
আরব-মার্কিন, ল্যাটিনো ও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটাররা ঐতিহাসিকভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক। তবে এবার ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। এ কারণে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে হারের মুখ দেখেছে তারা। দোদুল্যমান রাজ্য পেনসিলভানিয়ায় জয় পেয়েছেন ট্রাম্প। এর আগে রাজ্যটিতে ১৯৮৮ সালের পর শুধু ২০১৬ সালে হারের মুখ দেখে ডেমোক্র্যাটরা।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের নির্বাচনে আরব-মার্কিনি ও মুসলিমরা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেননি। জো বাইডেন প্রশাসনের ক্ষমতায় থাকাকালে গাজায় ইসরায়েল ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলায়, যা এখনও অব্যাহত আছে। এ নিয়ে দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলন চলাকালেও অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে বিক্ষোভ হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় প্রকাশ্যে আরব-মার্কিনিরা ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। আরব-মার্কিনিরা ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়ে এলেও বাইডেন-কমলা প্রশাসন তা আমলে নেয়নি। মার্কিন রাজনৈতিক কর্মী আদম আবুসালাহ বলেন, তারা বছরজুড়েই ডেমোক্র্যাটদের সতর্ক করে আসছেন। কিন্তু তারা তা আমলে নেননি।
সবকিছু ছাপিয়ে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে চলমান দুটি বড় যুদ্ধের শেষ ঘটাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন, তা মার্কিন ভোটাররা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্পের নেতৃত্বে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আলোচনার ভিত্তিতে ইউক্রেন সংকটের সমাধান হবে– এ ধরনের একটি ধারণার প্রচলন আছে। কার্যত ট্রাম্প চান বিদেশে যে কোনো সংঘাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখতে। গাজা ইস্যুতে ট্রাম্প ইসরায়েলের একনিষ্ঠ সমর্থক। তবে তিনি মনে করেন, এই অভিযানের সমাপ্তি ঘটানো উচিত। লেবাননেও ইসরায়েলের হামলা বন্ধ চান ট্রাম্প।
গত জুলাইয়ের শেষ দিকে চাপের মুখে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়ান জো বাইডেন। এর পর প্রার্থিতা পেয়ে দলকে চাঙ্গা করে তোলেন কমলা। দাতারা বিপুল অর্থ দিয়ে প্রচারণা এগিয়ে নেন। এরই মধ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে একটি বিতর্কে অংশ নিয়ে দৃশ্যমান জয় পান কমলা।
শুরুর দিকে বিভিন্ন জরিপে প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীকে ছাড়িয়েও যান তিনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আর শেষ রক্ষা হয়নি। বিভিন্ন জরিপে সমতা দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প বড় বিজয় পেয়েছেন। এর পেছনে মার্কিন পুরুষতন্ত্রকেও দায়ী করেছেন অনেকে। এর আগে ২০১৬ সালে ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিপরীতে জয় পান। মাঝখানে বাইডেনের সঙ্গে হেরে যান। কাকতালীয়ভাবে দু’বারই ট্রাম্প জিতেছেন নারী প্রার্থীর সঙ্গে।
নির্বাচনে নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেন থেকে দেওয়া ভাষণে বাইডেন বলেন, আমি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তাঁর বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করেছি, আমার পুরো প্রশাসনকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে তাঁর দলের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছি। এটা আমেরিকান জনগণের প্রাপ্য।
বাইডেন ট্রাম্পের বিজয়ের পর তৈরি হওয়া উদ্বেগের মধ্যেও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানান এবং নির্বাচনী ফলাফলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর জোর দেন। বাইডেন বলেন, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী নেতৃত্বের পরিবর্তন এবং এটি প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা ও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করে।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com