ঢাকা, ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫
Banglar Alo

শহীদের তালিকায় নাম ওঠাতে হয়রান পরিবার : আবেদন করা হলেও নাম তালিকাভুক্তিতে গড়িমসি, মেলেনি সরকারি সহায়তা

Publish : 03:02 AM, 09 January 2025.
শহীদের তালিকায় নাম ওঠাতে হয়রান পরিবার : আবেদন করা হলেও নাম তালিকাভুক্তিতে গড়িমসি, মেলেনি সরকারি সহায়তা

শহীদের তালিকায় নাম ওঠাতে হয়রান পরিবার : আবেদন করা হলেও নাম তালিকাভুক্তিতে গড়িমসি, মেলেনি সরকারি সহায়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক :

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। শহীদদের পরিবারে কান্না থামেনি এখনও। কেউ কাঁদছে সন্তান হারিয়ে, কেউ স্বামী হারিয়ে, কেউ বাবার শোকে। স্বজন হারানোর বেদনার সঙ্গে কারও কারও মনে যুক্ত হয়েছে ‘আক্ষেপ’। এ আক্ষেপের কারণ– এতদিনেও শহীদের তালিকায় জায়গা না হওয়া এবং সরকারি সহায়তা না জোটা। ইতোমধ্যে অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রথম ধাপের তালিকা প্রকাশ হয়েছে। তালিকায় রয়েছে ৮২৬ শহীদের নাম। এর মধ্যে ১২ জন সিলেটের। কিন্তু এই জেলার চার জনের নাম তালিকায় ওঠেনি। সহায়তা ও নাম তালিকাভুক্তির জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছে তাদের পরিবার; কোনো অগ্রগতি নেই। কেউ কোনো খোঁজও নেয় না তাদের। এতে হতাশ চার পরিবার।

শহীদের তালিকায় না ওঠা একটি নাম নাহেদুল ইসলাম। গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ইসলামাবাদের উছমান আলী ও শফিকুন নেছা দম্পতির সন্তান তিনি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে নাহেদুল বড়। বাবা অসুস্থ হওয়ায় অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে দিনমজুরি শুরু করেন। ২২ বছরের এই যুবক গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গুলিতে প্রাণ হারান। এর পর কেটে গেছে পাঁচ মাস। স্থানীয় এক ইউপি সদস্য তাঁর পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন। এ ছাড়া কোনো সহায়তা পায়নি দরিদ্র পরিবারটি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা শফিকুন নেছা বলেন, গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় নাহেদুলের বন্ধু সোহাগের মা ফোন করে জানান, সে সোনারহাট ক্যাম্পের সামনে গুলি খাইছে। পরে হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ পাই। তিনি জানান, নাহেদুলের মৃত্যুর পর সহায়তা ও নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে আবেদন করেছিলেন অসুস্থ বাবা উছমান আলী। ইউএনও অফিসে ঘুরেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু এখনও কিছু জানানো হয়নি।

শফিকুন নেছা যে ক্যাম্পের কথা বলছিলেন, সেটি গোয়াইনঘাটের সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের সামনে ৫ আগস্ট বিজিবির গুলিতে প্রাণ হারান নাহেদুলসহ তিনজন। অন্য দু’জন হলেন– অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম আহমদ রাহিম (১৪) ও ব্যবসায়ী সুমন মিয়া (২৫)। তাদের নামও ওঠেনি শহীদের তালিকায়।

উপজেলার পান্তুমাই গ্রামের ফখর উদ্দিন ও শিরিনা বেগম দম্পতির ছেলে সিয়াম আহমদ রাহিম। শিরিনা জানান, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবরে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বিজয় মিছিল যাচ্ছিল। এতে রাহিমও যোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে, সে বিজিবির গুলিতে মারা গেছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে ৭ অক্টোবর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান করে। সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ শিশুদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকার চেক ও ক্রেস্ট দেন উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশীদ। এর বাইরে কোনো সহায়তা মেলেনি।

রাহিমের চাচা আলীম উদ্দিন বলেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষে রাহিম গুলিবিদ্ধ হয়। নাহেদুল ও সুমনের লাশ ঘটনাস্থলেই পাওয়া যায়। তবে রাহিমের লাশ ৮ আগস্ট পার্শ্ববর্তী পিয়াইন নদীতে ভেসে ওঠে। তার নাম শহীদের তালিকায় তোলার জন্য জেলা প্রশাসক, ইউএনও, শিশু ও মহিলাবিষয়ক উপদেষ্টার দপ্তরে আবেদন করেছি। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছি। তিনি বলেছেন, বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেননি।

গোয়াইনঘাট সদর ইউনিয়নের ফেনাইকোনা গ্রামের আবদুন নূর বিলালের ছেলে সুমন মিয়া স মিলের ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। বিলাল জানান, সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পের সামনে বিজিবি সদস্যদের গুলিতে প্রাণ হারান সুমন। ছেলের মৃত্যুর পর প্রথমে ইউএনও, পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসক, মন্ত্রণালয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়কের কাছে তালিকাভুক্তির আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তারা আজও কোনো ব্যবস্থা নেননি।

সুমন নিহতের ঘটনায় ২৭ আগস্ট আদালতে মামলা করেন বিলাল। মামলায় সিলেট-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইমরান আহমদসহ ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করেন। এ ছাড়া ৫ আগস্ট সোনারহাট ক্যাম্পে কর্মরত সব বিজিবি সদস্যসহ অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদিকে ক্যাম্পে লুটের অভিযোগে বিজিবির পক্ষ থেকে মামলা হয়। ২০ আগস্ট যৌথ স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্রে বিজিবি সদস্যের গুলিতে সুমনের নিহতের বিষয়টি উল্লেখ করেন সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী সুমন ও ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মতিউর রহমান ৩০ সেপ্টেম্বর ইউএনওর কাছে একটি প্রতিবেদন দেন। তাতে রাহিম, নাহেদুল ও সুমন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

শহীদের তালিকায় তিনজনের নাম ওঠাতে গড়িমসির কারণ জানতে চাইলে গোয়াইনঘাট উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, তালিকা করার সময় তাদের বিষয়ে আপত্তি আসে। তারপরও পরিবারের পক্ষ থেকে তালিকাভুক্তির আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এখনও যাচাই-বাছাই চলছে। 

গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেন, তিনজন নিহতের বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়েছে। আমাদের কাছে যখন মামলাটি ছিল, তখন তদন্ত কর্মকর্তা লাশ উত্তোলনের আবেদন করেছিলেন। লাশ তোলার নির্দেশও দিয়েছিলেন আদালত। মামলাটি সিআইডিতে চলে যাওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি। তবে আদালতের আদেশ বহাল আছে।

সিলেট জেলায় জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে প্রাণ হারান ১৬ জন। গত ১ জানুয়ারি শহীদ ও আহতদের প্রথম ধাপের তালিকা প্রকাশ করে গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল। এ তালিকায় থাকা ৮২৬ শহীদের মধ্যে সিলেট জেলার ১২ জন হলেন– সানি আহমেদ, নাজমুল ইসলাম, হাউশ উদ্দিন, মিনহাজ আহমদ, পাবেল আহমদ কামরুল, জয় আহমেদ, তারেক আহমদ, তাজ উদ্দিন, আবু তাহের মো. তুরাব, সুহেল আহমেদ, মোস্তাক আহমেদ ও ময়নুল ইসলাম। 

তালিকায় নাহেদুল, রাহিম ও সুমন বাদেও আরেকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তিনি হলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ঝালোপাড়া আখড়া গলির বাসিন্দা অটোরিকশাচালক নিখিল চন্দ্র করের ছেলে পঙ্কজ কুমার কর।  

স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৫ আগস্ট বিকেলে বিজয় মিছিল কোতোয়ালি মডেল থানা এলাকায় পৌঁছালে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এ সময় মাদ্রাসাছাত্র হাফিজ পাবেল আহমদ কামরুল গুলিতে প্রাণ হারান। বিক্ষুব্ধ জনতা চড়াও হয় পুলিশের ওপর। এ সময় পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে অনেকের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হন পঙ্কজ। ৬ আগস্ট সকালে থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ২৮ আগস্ট কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা হয়েছে।

নিখিল চন্দ্র বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর দুই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মোট ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা পেয়েছি। কিন্তু পঙ্কজের নাম শহীদের তালিকায় ওঠেনি। নাম ওঠাতে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরও জানানো হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি নেই। কেউ খোঁজও নেয় না।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট জেলার মুখ্য সংগঠক নাইম শেহজাদ সমকালকে বলেন, আমাদের যাচাই-বাছাই কমিটি এখনও কাজ করছে। গোয়াইনঘাটে নিহত তিনজন ও পঙ্কজের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। 

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে তালিকা করা হয়। গোয়াইনঘাটে নিহত তিনজনের তালিকভুক্তির জন্য পরিবার থেকে আবেদন করা হয়েছিল। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে বলেছি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, কারা নিহত ও আহত হয়েছেন, সেটি নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। তারা যাচাই-বাছাই করে তালিকা দেয়। তালিকা থেকে কেউ বাদ পড়লে আবেদন করার সুযোগ আছে।

এদিকে গত সোমবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে শহীদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা থেকে বাদ পড়াদের পরিবার আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে আবেদন করতে পারবে।

Banglar Alo

সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড

৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০

নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]

©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com

Develop by _ DigitalSolutions.Ltd
শিরোনাম বিএনপির ২৪২৯ নেতাকর্মীকে গুম-খুনের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে শিরোনাম বাস-অ্যাম্বুলেন্স সংঘর্ষে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নিহত ৪ শিরোনাম লন্ডন ক্লিনিকে খালেদা জিয়া শিরোনাম সাড়ে সাত বছর পর মা-ছেলের সাক্ষাৎ শিরোনাম শুল্ক ও করের হার বাড়াতে বা কমাতে পারবে না এনবিআর শিরোনাম ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সুখকর নয়, তারপরও বাড়াতে হবে’