‘বগুড়া’ নাম থাকায় চাপা পড়ে প্রকল্প : বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণকাজ
পতিত হাসিনা সরকারের আমলে প্রকল্পের নামে অপচয় করা হয়েছে বিপুল অঙ্কের অর্থ, যার ঋণ ও সুদের জের টানতে হবে বহুদিন। অথচ ‘বগুড়া’ শব্দটি থাকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গুরুত্ব পায়নি। শেখ হাসিনার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও এ রেলপথটি ছিল উপেক্ষিত। ২০০৫ সালে নেওয়া এই প্রকল্পটির নাম বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়িত হলে সময় সাশ্রয় হতো ৩ ঘণ্টা।
বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের উদ্যোগ নেওয়া হয় অন্তত দেড় যুগ আগে। ২০১০ সালে প্রাক সমীক্ষা করা হয়। বহু ধাপ পেরিয়ে হাসিনা সরকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় ভারতীয় ঋণে (এলওসি-৩)। এ ঋণে প্রকল্পটি যুক্ত করার খেসারত হচ্ছে- নির্মাণকাজ শুরু তো দূরের কথা, বছরের পর বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও চিঠির জবাব মেলেনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। এখনও অধিগ্রহণেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
ট্রেনে বগুড়া থেকে দীর্ঘপথ ঘুরে ঢাকার দূরত্ব ৪০৫ কিলোমিটার। যানজট ছাড়া এ পথে বাসে যেতে সর্বোচ্চ সময় লাগে ৫ ঘণ্টা। অথচ ট্রেনে যেতে সময় ব্যয় হয় তার অনেক বেশি। বর্তমানে ১১২ কিলোমিটার পথ ঘুরে উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে সান্তাহার জংশন, নাটোর ও পাবনা-ঈশ্বরদী হয়ে বগুড়ায় যেতে হয়। প্রস্তাবিত রেলপথটি নির্মিত হলে সময় সাশ্রয় হবে ৩ ঘণ্টা আর কমবে অর্থের অপচয়। প্রকল্পটি ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর সময় বর্ধিত হয় চলতি বছর জুন পর্যন্ত। লাভ হয়নি। বাধ্য হয়ে আবারও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩০ জুন ধরা হয় বাস্তবায়নকাল। হাসিনা সরকারের সময়ে দায়িত্ব পালন করা অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা ‘বগুড়া’ নাম থাকায় প্রকল্পটির ফাইল নিচে চাপা দিয়ে রাখতেন। মনে করতেন, এ প্রকল্পের নাম বললে নাখোশ হবে কর্তৃপক্ষ। অথচ তারা জানেন, এই গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের যাতায়াত সহজ হবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, মূল অনুমোদিত প্রাক্কলনের মধ্যে ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭৯ মিলিন ডলার। এটি বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭৯ মিলিয়ন হয়েছে। এতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন। অতিরিক্ত এ অর্থায়নের জন্য ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সভায় উপস্থাপন করা হয়। এটি ২০তম, ২১তম ও ২২তম সভার কার্যবিবরণিতে উল্লেখ রয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থায়নের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয় ২০২৩ সালে। আজও এর জবাব পায়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ভারতীয় ঋণের দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রকল্পের কাজে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। ভারতের পক্ষ থেকে ‘না’ জবাব পেলেও বিকল্প অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধান করা যেত। এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না ওই জবাবের অভাবে। এ নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল বাকীর সভাপতিত্বে গত ৩১ অক্টোবর প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভা হয়। সেখানেও প্রসঙ্গটি আসে। তাই নতুন করে আরেক দফা চিঠি দেওয়ার নির্দেশনা দেন রেলসচিব। পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থায়নের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর প্রয়োজনে বিকল্প অর্থায়নে ইআরডিকে চিঠি দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী আমাদের সময়কে জানান, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথটি নির্মিত হলে অনেক সময় বাঁচবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে বিরাট সুবিধা হবে। কাজেই প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টপমোস্ট প্রায়োরিটি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা দুই দিন আগে চিঠি লিখেছি।
জানা যায়, প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা ঋণ দেবে ভারত। বাকি ২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা সরকারের ফান্ড থেকে ব্যয় হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ ছিল বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা। বাস্তবায়নের কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, ২০১০ সালের অ্যালাইনমেন্টে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। তাই সিরাজগঞ্জ শহর ও বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা বাদ দিয়ে বিকল্প পথে রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। নতুন রেলপথ ধরে সিরাজগঞ্জ জংশন, কৃষ্ণদিয়া, রায়গঞ্জ, চান্দাইকোনা, ছোনকা, শেরপুর, আরিয়াবাজার এবং রানীরহাট এই আটটি স্টেশন করা হবে। এ ছাড়া কাহালু স্টেশন পুনর্নির্মাণ ও শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশনের সম্প্রসারণ রয়েছে প্রকল্পের আওতায়। এমব্যাংকমেন্টসহ ডুয়েলগেজ রেলপথটি হবে ৮৫ কিলোমিটার। ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত রুট ছিল বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত। এদিকে যমুনা নদীতে পৃথক রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তাই যমুনা সেতু উত্তর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এ রেলপথটি নির্মিত হলে যমুনায় পৃথক রেলসেতু নির্মাণের সত্যিকারের সুফল মিলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যমুনা রেলসেতুটি আগামী মাসে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১০ সালে রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রস্তাবিত অ্যালাইনমেন্টে বিভিন্ন অবকাঠামো ও জনবসতি গড়ে উঠেছে। কিছু স্থানে তৈরি হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। এখন উচ্ছেদ করা এবং ক্ষতিপূরণ দিয়ে রেলপথটি নির্মাণ করা অত্যধিক সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সিরাজগঞ্জ শহরের সঙ্গে যুক্ত হবে না প্রস্তাবিত রেললাইন। বাধ্য হয়ে শহর এবং বাজারের বাইরে দিয়ে এটি নির্মাণ করা হবে। চারটি অ্যালাইনমেন্ট প্রস্তাব করে এর মধ্যে সবচেয়ে কম জনবসতি এলাকায় রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগে প্রস্তাব করা হয়েছিল মিটারগেজ রেলপথের আর এখন করা হবে ডুয়েলগেজ। তখন রেলপথটির নাম ছিল বগুড়া-জামতৈল।
নতুন চার অ্যালাইনমেন্ট নির্ধারণ প্রসঙ্গে বর্তমান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১০ সালে স্মেক ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড দুটি অ্যালাইনমেন্ট প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু সেই অ্যালাইনমেন্ট বরাবর বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি হওয়ায় এই রুটে রেলপথ নির্মাণ সমীচীন হবে না। কারণ, এই রুটে রেলপথ তৈরি করলে পুনর্বাসন খরচ অনেকে বেড়ে যাবে।
২০১০ সালে এডিবির অর্থায়নে প্রাক-সমীক্ষা করা হয়। ২০১৭ সালে ভারতের তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অর্থায়নে রেলপথটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন এ ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com