খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে ভাগ্য খোলে হারুনের
হারুনুর রশীদ, আলোচিত দুদক কর্মকর্তা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এক মামলা করে ভাগ্যের চাকা খোলে তাঁর। গত সাড়ে ১৫ বছর লাগামহীন দুর্নীতি করলেও হারুনের টিকিটি ছুঁতে পারেনি কেউ; বরং আওয়ামী লীগ সরকার থেকে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন অনৈতিক নানা সুবিধা। গড়েছেন বিত্ত-বৈভব। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে লাপাত্তা দুদকের সাবেক উপপরিচালক হারুনুর রশীদ।
এতিমদের জন্য কুয়েত আমিরের সহায়তার ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন অভিযোগ এনে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রাজধানীর রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা করেন দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুনুর রশীদ। ২০০৯ সালে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত-৫ খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শেষে ওই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট তাঁর সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। একই সঙ্গে সাজা বাড়িয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) মঞ্জুর করেছেন।
অভিযোগপত্র ও বিচারিক আদালতের রায়ের অংশ বিশেষ তুলে ধরে দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান আদালতকে বলেছেন, ‘এখানে টাকা আত্মসাতের কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফান্ড মুভ হয়েছে। টাকা অ্যাকাউন্টে জমা আছে। আত্মসাতের কিছু নেই।’ অথচ শুরু থেকেই খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ট্রাস্টি কিংবা সুবিধাভোগী ছিলেন না খালেদা জিয়া। ব্যাংক হিসাবে জমা ২ কোটি ১০ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে কয়েক গুণ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক কর্মকর্তা হারুনুর রশীদ ভুয়া মামলা দিয়ে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির অনেককে ফাঁসিয়েছেন। শুধু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা নয়, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এয়ারবাস দুর্নীতি মামলাও করেন হারুন। তাঁর হাত থেকে রেহাই পাননি বিএনপির স্থানীয় নেতারাও।
রাজধানীর বাড্ডা থানা বিএনপির সহসভাপতি মনির হোসেন ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে আয়করে দাখিল করা সম্পদকে অবৈধ দেখিয়ে মামলার মাধ্যমে দীর্ঘদিন জেলে রাখা হয় তাঁকে। বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থক পেলেই টার্গেট করে ফাঁসাতেন তিনি। এভাবে হারুন আওয়ামী লীগের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়ে নিয়েছেন একের পর এক অনৈতিক সুবিধা।
কর্মকর্তারা জানান, হারুনের ভয়ে তখন দুদকে সবাই তটস্থ থাকতেন। খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার দিন তিনি পুরো কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ করেন। আওয়ামী লীগের পুরো সময় হারুনের দাপট ছিল মন্ত্রী-এমপির চেয়ে বেশি। এমনকি চাকরি থেকে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটি (পিআরএল) কাটানোর সময় সরকারের সুবিধা নিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলায় লড়েন হারুন।
সূত্র জানায়, সরকারি আনুকূল্যে হারুন নিজ জেলা ফরিদপুর শহরে দুটি বহুতলসহ একাধিক বাড়ি করেছেন। এর মধ্যে পৌরসভার ৭৭/১ বাদামতলী সড়কে ছয়তলা ভবন, সঙ্গে রয়েছে আরেকটি একতলা ভবন ও টিনশেড বাড়ি। ২০ নম্বর রোডের ২৩-এ হোল্ডিংয়ে রয়েছে আরেকটি পাঁচতলা বাড়ি। ঢাকার মিরপুরেও রয়েছে একটি ছয়তলা বাড়ি। এ ছাড়া নামে-বেনামে ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। তবে এসব সম্পদ তিনি আয়কর বিবরণীতে দেখাননি। শিবচর এলাকার বাখরেকান্দি এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ থেকেও দেড় কোটি টাকার বেশি কামিয়েছেন হারুন।
দুদক সূত্র জানায়, হারুন ১৯৭৯ সালে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর ‘সহকারী’ হিসেবে যোগদান করেন। তবে তাঁর যোগদানের কোনো কাগজ দুদকে পাওয়া যায়নি। ২০০৪ সালে ব্যুরো বিলুপ্ত করে দুদক গঠনের প্রাক্কালে বিগত দিনে চাকরির যোগ্যতা যাচাইকল্পে তাঁকেসহ ২৬৩ জনকে চাকরিতে আর বহাল করা হয়নি। তবে ২০০৮ সালে লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী দুদক চেয়ারম্যান হওয়ার পর হারুনসহ বাদ পড়া ১১২ জনকে বহাল করেন। ওই বছরের মার্চ থেকে পুরো এক বছর তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির প্রভাবশালী অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর পর ২০১২ সালে এক আদেশে সহকারী পরিচালক হারুনকে বিগত পাঁচ বছরের ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা দেয় সরকার। অভিযোগ রয়েছে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার পুরস্কার হিসেবে তাঁকে জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার সাজার রায় ঘোষণার কিছুদিন পর হারুন পিএলআরে যান। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে আপিল করলে ওই বছরের জুলাইয়ে দুদক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মঈদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য দুদক আইনজীবীদের সহায়তা করতে একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আপিল বোর্ডে হারুনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পাঁচ দিন পর দুদক মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাঁকে ভাতাদি প্রদানের আদেশ দেওয়া হয়। মূলত হারুনকে খুশি করতে এ অন্যায় অফিস আদেশ জারি করা হয় বলে দুদকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সমকালকে জানিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে হারুনুর রশীদের মোবাইল নম্বরে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। ফরিদপুর ও ঢাকার বাসভবনে গিয়ে তাঁকে, এমনকি পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির তত্ত্বাবধায়করা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সবাই বাড়িছাড়া।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com