আমুর পছন্দের ঠিকাদার ছাড়া কেউ পাননি কাজ : ৯ বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা
ঝালকাঠির স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে (এলজিইডি) সাবেক এমপি আমির হোসেন আমুর অনুসারীরা গড়ে তোলেন টেন্ডার সিন্ডিকেট। তাদের পছন্দের লোক ছাড়া কেউ পাননি বড় কাজের ঠিকাদারি। ২০১৫ সাল থেকে ৯ বছরে ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার কাজ ভাগবাটোয়ারা করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এসব কাজের ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে আমু নিয়েছেন প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রকল্পে ১ হাজার ৯৪টি প্যাকেজে এসব কাজের টেন্ডার হয়।
প্রকল্পের কাজে ব্যয় ধরা হতো অনেক বেশি, যাতে ধাপে ধাপে কমিশন আদায়ে সুবিধা হয়। এ ছাড়া অধিকাংশ কাজ আংশিক সম্পন্ন করে অতিরিক্ত বিল নিয়েছেন ঠিকাদাররা। অভিযোগ ওঠে, এতে জড়িত ছিলেন এলজিইডির তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ কার্যালয়ের একটি চক্র। তারা সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়া কোনো ঠিকাদারের কাছে দরপত্র বিক্রি করতেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ঠিকাদার জানান, ঝালকাঠি-২ (ঝালকাঠি-নলছিটি) আসনের সাবেক এমপি আমুর ঢাকার বাসভবনে অথবা বরিশালের বাসায় কাজের ১০ শতাংশ নগদ দিয়ে আসার পর কার্যাদেশ দেওয়া হতো। শুধু এলজিইডি নয়; সড়ক বিভাগ, গণপূর্ত, পাবলিক হেলথ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সব প্রকৌশল বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করত সিন্ডিকেট। টেন্ডার উন্মুক্ত থাকলেও হয়রানির ভয়ে আমুর পছন্দের ব্যক্তি ছাড়া কোনো ঠিকাদার অংশ নিতে পারতেন না। এমনকি দলীয় লোকজনও ছাড় পাননি। যুবলীগ নেতা সৈয়দ হাদিসুর রহমান মিলন টেন্ডার সিন্ডিকেটের তোয়াক্কা না করে দরপত্র দিয়ে কাজ নেওয়ায় তাঁকে ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর কুপিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় মিলনের স্ত্রী মারিয়া ইসলাম বাদী হয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকারী রেজাউল করিম জাকির, আফিজ আল মাহমুদসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এই মামলায় আমুর হস্তক্ষেপে চার্জশিট দেওয়া হয় পরিকল্পনাকারী আসামিদের বাদ দিয়ে।
এলজিইডির গত ৯ বছরে বঞ্চিত ঠিকাদাররা জানান, ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিতেন চারজন। এলাকায় তারা চার খলিফা হিসেবে পরিচিত। তারা হলেন এমটি বিল্ডার্সের মালিক কামাল শরীফ, জিসান এন্টারপ্রাইজের হাফিজ আল মাহমুদ, শান্ত এন্টারপ্রাইজের নুরুল আমিন সুরুজ এবং মুনমুন কনস্ট্রাকশনের রেজাউল করিম জাকির। এই চারজন জেলার এলজিইডির সব কাজ ভাগবাটোয়ারা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আরও ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার। তাদের মধ্যে আছেন মোহাম্মদ মতিউর রহমান ওরফে মতি, রফিকুল ইসলাম নবীন, গাজী সানাউল হক, জয়ন্ত কুমার দাস, গোলাম মাওলা ফরহাদ। সরকার পতনের পর তারা সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। কোটি কোটি টাকার কাজ অসমাপ্ত পড়ে আছে।
এ প্রসঙ্গে ঠিকাদার মতিউর রহমান বলেন, ‘আমু ভাইয়ের ১০ শতাংশ কমিশন ছিল ওপেন সিক্রেট। ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন সুরুজের নেতৃত্বে চার খলিফার সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। আমি কিছু কাজ করেছি। কিন্তু আমার ওপরেও স্টিমরোলার চালানো হয়েছে। ঢাকা থেকে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে আনার পর তাদের দাবি করা টাকা না দিলে আরেকজনের কাছে বেশি কমিশনে কাজ বিক্রি করে দিত। কাজের মোট বরাদ্দ থেকে আমু ভাই এবং চার খলিফার কমিশন দাবি করা হতো। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে কাজ নিতেন ঠিকাদাররা।’ মতিউর আরও বলেন, ‘আমি একটি সেতুর ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার কাজ পাস করিয়ে এনেছিলাম। সেই কাজের টেন্ডার দেওয়ার পর আমু ভাইয়ের কাছে যেতে একটু দেরি করায় বাসায় হামলা চালিয়েছে। সেই কাজ আরেকজনের কাছে বিক্রি করেছে। শেষে আমু ভাইকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে মাফ চেয়ে এসেছি। সব লেনদেন শেষ হলে কার্যাদেশ দেওয়া হতো। তখন অফিসও কমিশন নিত ৭ শতাংশ।’
সিন্ডিকেটের হামলায় আহত মিলনের স্ত্রী মারিয়া ইসলাম বলেন, ‘হাফিজ ও জাকির দলবল নিয়ে হামলা করে। এদের কাছে দল ও মানবতা বলতে কিছু নেই।’ আমু প্রসঙ্গে মিলন বলেন, ‘হামলার পর থেকে আমি খুব অসুস্থ। যত মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন, সে অভিশাপে তিনি শেষ হবেন। আমু ব্রিজের কাজে ১৫ শতাংশ কমিশন নিতেন। স্বাভাবিক কাজে নিতেন ১০ শতাংশ। ঢাকার ধানমন্ডিতে আমুর বাসার কম্পিউটার অপারেটর শাওন খান ঠিকাদারি কাজের তদবির করেই কোটি কোটি টাকার মালিক। চার খলিফার প্রধান নুরুল আমিন সুরুজ ২০০ কোটি টাকার মালিক। তিনি সব কিছু করেছেন কানাডায়।’
জেলা এলজিইডির কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ বছরে ১ হাজার ৯৪টি প্যাকেজে ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকার কাজের টেন্ডার হয়েছে। ৭০ শতাংশের বেশি কাজ টেন্ডার সিন্ডিকেট করেছে। কিছু ছিল নামে-বেনামের লাইসেন্সে নেওয়া। আর কিছু ঠিকাদার আমুকে কমিশন দিয়ে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে কাজ কিনে নিয়ে করেছেন। কম্পিউটার অপারেটর শাওন খান এবং আমুর ভায়রা ও ব্যক্তিগত সহকারী ফকরুল মজিদ কিরন কার্যাদেশ বিক্রি বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তারা মোবাইল ফোন বন্ধ করে গা-ঢাকা দিয়েছেন।
ঝালকাঠিতে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মো. সেলিম সরকার। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন রুহুল আমিন। অভিযোগ উঠেছে, তারা টেন্ডার জমা নেওয়া থেকে খোলা পর্যন্ত নিতেন ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কার্যাদেশের বিনিময়ে নিতেন আরও দশমিক ৫ শতাংশ এবং চূড়ান্ত বিলের সময় নিতেন ২ শতাংশ। এ ছাড়া অফিসে টাকা দিতে হতো নানা স্তরে।
এলজিইডির দু’জন পুরোনো ঠিকাদার সোম এন্টারপ্রাইজের সুশান্ত এবং ব্রহ্ম এন্টারপ্রাইজের নারায়ণ ব্রহ্ম জানান, তারা গত ১৫ বছরে এলজিইডির কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। আমুর ১০ শতাংশ, সিন্ডিকেটের ২ শতাংশ এবং অফিসের ৭ শতাংশ দিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ ঠিকাদাররা অনলাইনে টেন্ডারে অংশ নিয়ে অফিসে গেলেই হয়রানি করা হতো। আবার অফিসে গিয়ে দরপত্র কিনতে চাইলে বলা হতো, সিন্ডিকেটের অনুমতি লাগবে। ঠিকাদার বিষ্ণু ধর জানান, সিন্ডিকেটের লোকজনের লাইসেন্সের সক্ষমতা বাড়িয়ে তৎকালীন দুই নির্বাহী প্রকৌশলী কাজ পেতে সুযোগ করে দেন। সাধারণ ঠিকাদারদের বেশি সক্ষমতার লাইসেন্স না থাকায় কৌশলে টেন্ডারে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে সাবেক দুই নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম বলেন, তিনি ২০২২ সালের শেষ দিকে এখানে যোগদান করে টেন্ডার চুক্তির সব শর্ত যথাযথভাবে পালনে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com