ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
Banglar Alo

জাহাজে ৭ খুন : বিয়েবাড়িতে চলছে মাতম, মরদেহের অপেক্ষায় পরিবারগুলো

Publish : 04:51 AM, 26 December 2024.
জাহাজে ৭ খুন : বিয়েবাড়িতে চলছে মাতম, মরদেহের অপেক্ষায় পরিবারগুলো

জাহাজে ৭ খুন : বিয়েবাড়িতে চলছে মাতম, মরদেহের অপেক্ষায় পরিবারগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক :

১০ জানুয়ারি বড় মেয়ে হাবিবা আক্তারের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছিল। বরের বাড়ি মাগুরা। বড় ফরিদপুরের একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। এদিকে বাড়িতে বিয়ের কেনাকাটা, বাজারের লিস্ট, বাবুর্চি ঠিক করা, আত্মীয়দের দাওয়াতসহ প্রায় সব আয়োজনই সম্পন্ন। এখন শুধু বাড়ির কর্তা জাহাজ মাস্টার গোলাম কিবরিয়ার (৬০) আসার অপেক্ষায় পরিবার। কিন্তু রোববার দিবাগত রাতের কোনও একসময় নৃশংসভাবে খুন করা হয় কিবরিয়া বিশ্বাসসহ জাহাজে থাকা ৭ নাবিককে।

নিহত গোলাম কিবরিয়া, শেখ সবুজ এবং একমাত্র জীবিত আহত জুয়েল বাড়ি ফরিদপুর সদরের গেরদা ইউনিয়নে।

মঙ্গলবার দুপুরে গেরদা ইউনিয়নের জোয়াইর মোড় এলাকার নিজ বাড়িতে গিয়ে কথা হয় কিবরিয়ার স্ত্রী রোজি বেগমের (৫০) সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলতে বলতেই তিনি দু’বার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পাশের প্রতিবেশীরা তাকে আবার সুস্থ করতে ও সমবেদনা জানাতে থাকেন।

এর মাঝেই রোজি বেগম বলেন, গত রোববার রাত ৮টার দিকে মোবাইলে শেষ কথা হয় স্বামীর সঙ্গে। তখন তার স্বামী জানান, আমি আজ একটু ক্লান্ত, একটু রেস্ট নেই। এই রেস্টই তার জীবনের শেষ রেস্ট হবে তা কি কেউ জানতো বলে, আল্লাহ আপনি আমাকে কী পরিক্ষায় ফেললেন” বলে আবারও তিনি মূর্ছা যান।

প্রায় আধাঘণ্টা চেষ্টার পর আবার রোজি বেগমের জ্ঞান ফেরে। শোকার্ত পরিবারে সবার মনে জমাটবাঁধা চাপা কান্নার ঢেউ।

রোজি বেগম বলেন, শেষ ফোনে কথা হওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, জাহাজের মাল খালাস করেই বাড়ি ফিরবেন স্বামী। আজকালের মধ্যেই আবার কথা বলেছিলেন তিনি। তিনি যে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরবেন তা কী করে জানবো বলে, “আল্লাহ আপনি আমাকে কি পরিক্ষায় ফেললেন” বলে আবারও তিনি মূর্ছা জান।

তার সঙ্গে আর কথা বলার পরিবেশ না পেয়ে ঘর থেকে বের হলে দেখা যায়, মরদেহের খাটিয়া বাড়ির উঠানে রাখা। খাটিয়ার উপরে রয়েছে চাটিয়া। পাশের কবরস্থানে দাফন করার জন্য কবরও খুঁড়ে রাখতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রাতের কোনও এক সময় গোলাম কিবরিয়ার মরদেহ বাড়িতে আশার কথা ছিল।

ফরিদপুর জেলা সদরের গেরদা ইউনিয়নের জোয়াইর গ্রামের বাসিন্দা আনিসুর রহমানের বড় ছেলে গোলাম কিবরিয়া। প্রায় ৪০ বছর আগে জাহাজের কাজে যোগ দেন। কিবরিয়ার বাবাও জাহাজের মাস্টার ছিলেন ব্রিটিশ আমলে। বাবা আনিসুর রহমান চাকরির মেয়াদ শেষ হলে বড় ছেলে কিবরিয়া চাকরি গ্রহণ করেন। এমভি আল বাখেরা জাহাজে তার প্রায় ৪০ বছরের চাকরি জীবনের শেষ সময়ের দিকে এসেছিলেন কিবরিয়া। শেষ ট্রিপটি পরিপূর্ণ করে আর চাকরিতে যোগদান করবেন না ঠিক করেছিলেন। নিজের চাকরিটা পরিবারের কাউকে দিয়ে যেতে পারেন এজন্য নিজের ভাগ্নে শেখ সবুজকে সঙ্গে করে নিয়ে যান একমাস আগে। তিনি চেয়েছিলেন সবুজকে কাজ শিখিয়ে তাকেই নিজের স্থান দিয়ে যাবেন। কিন্তু সোমবার সকালে চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীতে ওই জাহাজ থেকে খুন হওয়া আরও ছয়জনের সঙ্গে উদ্ধার করা হয় শেষ সবুজের মরদেহ। শেখ সবুজের মরদেহও সেখানে শনাক্ত করেছেন তার ভাই ফারুক শেখ। মামা-ভাগ্নের নিহতের খবরে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ।

কিবরিয়া বিশ্বাসের ফুপু রাবেয়া বেগম বলেন, কিবরিয়ার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে দুজন বড়, ছেলে ছোট। কিবরিয়ার বাবা আনিচ বিশ্বাসও একই কাজ করতেন। কিবরিয়ার চাকরি তার বাবাই দিয়ে গেছে। পরিবারটি এখন এতিম হয়ে গেলে। এদের এখন কী হবে, কে দেখবে তাদের।

কিবরিয়া বিশ্বাসের ভাই সিরাজ বিশ্বাস বলেন, জাহাজের ওই ট্রিপটি ছিল আমার ভাইয়ের শেষ কাজ। মাল রেখেই বাড়ি চলে আসতে চেয়েছিলেন। এসে বড় আয়োজন করে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখে মেয়ের বিয়ের দিন নির্ধারণ করেছিলেন। সব প্রস্তুতিও শেষ।

খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন মো. মোজাহিদুল রহমান নামে এক স্বজন। ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের কাছে মনে হচ্ছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারণ, জাহাজের কোনো মালামাল নেওয়া হয়নি। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। যাতে এমন আর নৃশংস হত্যাকাণ্ড না ঘটে।

এদিকে নিহতের বাড়িতে পরিদর্শনে আসেন মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের আরেক জাহাজ এমভি মুগরিব ফোরের মাস্টার আবুল কাশেম। কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনোপ্রকার সাহায্যের এখন পর্যন্ত ঘোষণা দেওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং খুনিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তা‌র দাবিতে আলটিমেটাম দিয়েছি। একইসঙ্গে সরকারের কাছে প্রতি পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ বাদ ২০ লাখ টাকা দাবি করেছি। অন্যথায় জাহাজ শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করবে।

এদিকে কিবরিয়ার ভাগনে শেখ সবুজের বাড়িতেও চলছে মাতম। মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরেই সবুজদের বাড়ি। তার বৃদ্ধ মা রাজিয়া বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মামা-ভাগ্নে‌র একসঙ্গে কাজ, একসঙ্গেই মৃত্যু। এমন নিদারুণ কষ্টের উক্তি করছিলেন সবুজের বাড়িতে আসা প্রতিবেশীরা।

পরিবার সূত্র জানায়, নিহত সবুজ শেখ ওই জাহাজের লস্কর পদে কর্মরত ছিলেন। গোলাম কিবরিয়া চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড়। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ভাগ্নে সবুজ শেখ ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে চতুর্থ।

সবুজের মেজো ভাই মিজানুর রহমান বলেন, সবুজ মামার সঙ্গে কাজে যায়। সোমবার বিকেলে মোবাইলের মাধ্যমে জানতে পারি মামাসহ সবুজকে হত্যা করা হয়েছে।

নিহত সবুজ শেখের বড় ভাই ফারুখ শেখ বলেন, মাসখানেক আগে তারা দুজন বাড়িতে এসেছিলেন। সোমবার বিকেলে তাদের মৃত্যুর খবর পাই। কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এখন পর্যন্ত কিছুই জানতে পারিনি। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা চাঁদপুরে গেছেন। বিস্তারিত পরে জানাতে পারব।

এদিকে চিকিৎসাধীন একমাত্র জীবিত আহত ব্যক্তি জুয়েল রানা (৩৫)। তবে এখনও শঙ্কামুক্ত নন তিনি। জুয়েলের বাড়ি একই ইউনিয়নের জোয়াইড় মোড়ের পাশের গ্রাম জামতলা এলাকায়। চার বছর ধরে তিনি জাহাজে সুকানির কাজ করছিলেন।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল সূত্রে জানা যায়, দুর্বৃত্তের হামলার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আহত জুয়েলকে রাত ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে নাক, কান ও গলা বিভাগে তাকে ভর্তি করা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেলের আবাসিক অফিসার সিরাজ সালেক জানিয়েছেন, জুয়েল রানার শ্বাসনালী কেটে যাওয়ায় সেখানে টিউব যুক্ত করা হয়েছে। তবে তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন।

প্রসঙ্গত, চাঁদপুরের মেঘনা নদীর হাইমচর উপজেলার ইশানবালা এলাকায় এমভি আল-বাখেরা নামে সারবাহী একটি জাহাজে দুর্বৃত্তরা আক্রমণ চালিয়ে ৭ জনকে গলাকেটে ও মাথা থেঁতলে হত্যা করে। পণ্যবাহী জাহাজটি গত রোববার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রামের কাফকো সার কারখানার ঘাট থেকে যাত্রা করে। এরমধ্যে কোম্পানির মালিক শিপন বাখেরা জাহাজে ফোন করে কাউকে পাননি। এতে সন্দেহ হয় মালিকপক্ষের। জাহাজের অবস্থান এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের অন্য জাহাজ মুগনি-৩ থেকে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়। ওই সময় মুগনি জাহাজটি মাওয়া থেকে ঘটনাস্থল দিয়ে অতিক্রম করার সময় বাখেরা জাহাজটি দেখতে পায়। ওই সময় তারা জাহাজের লোকদের রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দেন। ফোন পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে নিহত ও আহতদের উদ্ধার করেন। তারা যখন জাহাজটিতে উঠেছিলেন, তখন ইঞ্জিন বন্ধ ছিল।

Banglar Alo

সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড

৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০

নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]

©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com

Develop by _ DigitalSolutions.Ltd
শিরোনাম ফায়ার ফাইটার নিহতের দায় নিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শিরোনাম সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন শিরোনাম ফেনী জেলা যুবদলের কমিটির পদ পেতে জোর লবিং শিরোনাম বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না: আসিফ মাহমুদ শিরোনাম ভয় পেলেন না সোনাক্ষী-জহির, ক্যামেরার সামনেই ঘটালেন সাহসী কাণ্ড! শিরোনাম আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট ও নয়তলা