প্রচণ্ড গ্যাস সংকটেও চলছে চুরি-অপচয়
প্রচ- গ্যাস সংকটে দেশ। সরকারি-বেসরকারি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে কমপক্ষে ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে সর্বসাকল্যে সরবরাহ করা হয় ২৭০০ থেকে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাসও (এলএনজি)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার গ্যাস ‘সিস্টেম লস’ হয়েছে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। শতকরার হিসাবে যা ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ অনেক বেশি এবং এটি মোটেও সিস্টেম লস নয়। গ্যাসের অপব্যবহার ও চুরিকে সিস্টেম লস বলে চালিয়ে দিচ্ছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। এসব চুরির দায়ভার সাধারণ গ্রাহকের কাঁধেই পড়ছে কোনো না কোনোভাবে। তারা বলছেন, বিভিন্ন খাতে চলছে গ্যাস চুরি, অপব্যবহার ও বাইপাস সংযোগ। তদুপরি রয়েছে পুরনো পাইপলাইনের লিকেজ, যা বন্ধ করতে পারছে না গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রতিনিয়ত এসব বেড়েই চলেছে।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি অব বাংলাদেশসহ (জিটিসিএল) ৭টি গ্যাস কোম্পানির সিস্টেম লস অনেক বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, একসময় উৎসস্থল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে গ্যাস সরবরাহ করত জিটিসিএল। মাস শেষে বিভিন্ন কোম্পানির সিস্টেম লস নির্ধারণ করা হতো অনেকটা অনুমাননির্ভর। সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস তিতাস গ্যাস কোম্পানির ওপের চাপিয়ে দেওয়া হতো। এরপর তিতাস গ্যাস কোম্পানি গড়পড়তা সিস্টেম লস চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করে গ্যাসের প্রবেশপথে মিটারিংয়ের দাবি জানিয়ে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দেয়। পরে পেট্রোবাংলা কয়েক বছর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জিটিসিএল থেকে শুরু করে সব গ্যাস বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের ইন-পয়েন্টে মিটার স্থাপন করে। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে মিটার স্থাপন করা হয়েছে। এসব মিটারের মাধ্যমে সিস্টেম লস বা গ্যাসের চুরি নির্ধারণ করা হয় । তবে গ্যাস বিতরণ পয়েন্টে মিটার স্থাপনের বিরোধিতা করে আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন জিটিসিএলের কর্মকর্তারা।
পেট্রোবাংলা বলছে, মিটার স্থাপনের ফলে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় কোন পর্যায়ে সিস্টেম লস কতটুকু এবং তার আর্থিক মূল্য কতÑ তা পুরোপুরি নিরূপণ করা যাচ্ছে। এক হিসাবে পেট্রোবাংলা দেখিয়েছে, চলতি বছরের মে মাসে সিস্টেম লসের কারণে জিটিসিএল প্রান্তে সাড়ে ৪৫ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়েছে। বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির ৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা গ্যাস চুরি বা সিস্টেম লস হয়েছে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির হয়েছে ১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার, জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির তিন কোটি ৭০ লাখ টাকার, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানিরও সিস্টেম লস হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস হয়েছে। এ জন্য তিতাসে, ৩২৫ দশমিক ৭৬ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলা সিস্টেম লসের কারণ এবং সেটা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখছে। এ ক্ষেত্রে বাখরাবাদ ও তিতাসের সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করেছে কোম্পানিটি। এ দুটো কোম্পানির পাইপলাইন অনেক বছরের পুরনো। এ দুটি কোম্পানিতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ সংযোগ, বাইপাস, পাইপলাইনের লিকেজ, কারখানায় গ্যাস চুরি ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া এ দুটো গ্যাস বিতরণ এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার নানামুখী কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্যাসের বিতরণ পাইপলাইন। ছিদ্র হয়ে অপচয় হচ্ছে গ্যাসের। এ ছাড়া গ্যাস খাতে বিভিন্ন স্থাপনায় যে ধরনের ফিটিংস ব্যবহৃত হয় সেগুলোতেও অনেক লিকেজ তৈরি করেছে। পেট্রোবাংলা বলছে, ২০১২ সাল থেকে মূলত সব ধরনের আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু এ খাতে গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার এত বেড়েছে, যে গত এক যুগেও সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বিশেষ করে একই ভবনে চুলা এক্সটেনশন বা বর্ধিত হয়েছে লাখ লাখ। এগুলো বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এদিকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত সিস্টেম লসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ক্রমান্বয়ে সিস্টেম লস বেড়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে যেখানে গড় সিস্টেম লস ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, সেখানে একই বছরের ডিসেম্বরে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস হওয়া কোম্পানির মধ্যে আছে তিতাস গ্যাস এবং বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। ২০২৩ সালের এপ্রিলে তিতাসের সিস্টেম লস প্রায় ১১ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। বাখরাবাদের ডিসেম্বরে সিস্টেম লস হয়েছে ১১ শতাংশ। এদিকে ২০২৪ সালে জানুয়ারিতে গড় সিস্টেম লস হয়েছে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। মার্চ মাসে ১০ শতাংশের বেশি।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে গ্যাসের সরবরাহ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং ব্যবস্থা পুরোপুরি ম্যানুয়ালি করা হয়। তিনি বলেন, একটা জোনের যত শিল্পকারখানা আছে, সেখানে কেউ অবৈধভাবে গ্যাসের ব্যবহার করছে কিনা অথবা কোনো বাইপাস গ্যাস সংযোগ আছে কিনা অথবা মিটার টেম্পারিং আছে কিনা সেগুলো মূলত ওই জোনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা বা সততার উপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হরহামেশা অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের অসততা ও অর্থলোভের কারণে গ্যাসের অপব্যবহার বন্ধ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে।
এ কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসের চুরি ও অপচয় রোধে পুরো বিষয়টিকে তথ্যপ্রযুুক্তিনির্ভর করতে হবে যাতে কোথাও কোনো অনিয়ম হলে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা যায়। তবে সেটা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে। তিনি আরও বলেন, তিতাসসহ অধিকাংশ কোম্পানিতে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ সেলস বিভাগে বা জোনে ঘুরে ফিরে কিছু কর্মকর্তা, ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার, ডিজিএম পদ আঁকড়ে রাখেন। তারা যেখানেই যান, ঘুরেফিরে সেলস জোনে থাকতে চান। এখানে অবশ্যই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় আছে। তিনি বলেন, কোম্পানির মানব সম্পদ বিভাগও ঘুরে ফিরে কিছু কর্মকর্তাকেই সেলসে রাখছে। এসব বিষয়েও দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাসমুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, সিস্টেম লস কত হবে, এর একটা আর্ন্তজাতিক মানদ- থাকে। একটা শতকরা হিসাব থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই মানদ- নেই। কাগজ-কলমে যা দেখানো হয়, বাস্তবে তারচেয়ে অনেক বেশি। আর সিস্টেম লসের নামে গ্যাস যে চুরি হয়, সেটার দায়ভারও গ্রাহকের ঘাড়ে চাপানো হয়। তিনি বলেন, সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে গ্যাসের চুরি বন্ধ হবে না।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com