সন্তানের জন্মসনদ পেতে বাবা-মায়ের ‘পুনর্জন্ম’
জন্ম ও মৃত্যুসনদ পেতে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তির যেন অন্ত নেই। বিশেষ করে সন্তানের জন্মসনদ নিতে গিয়ে বাবা-মাকে রীতিমতো পুনর্জন্ম নিতে হচ্ছে। মূলত জটিল নিয়ম এবং সার্ভার জটিলতার কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে সারাদেশে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ছেলে-মেয়েদের জন্মসনদ পেতে হলে বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এখানেই শেষ নয়। আবার বাবা-মায়ের সনদ নিতে গেলেও তার বাবা-মায়েরও সনদ লাগে। এই চক্রাকার বৃত্তে ঘুরতে গিয়ে দিশাহারা সেবাপ্রত্যাশীরা। কারণ আর কিছুদিন বাদেই শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষ। নতুন শিক্ষাবর্ষ মানেই ছোট্ট সোনামণিদের স্কুলে ভর্তি। আর ভর্তি করাতে গিয়েই বাবা-মাকে নতুন করে জন্ম নিতে হচ্ছে। কারণ বাবা-মায়ের জন্মসনদ অনলাইনে না থাকলে সন্তানেরটা নেওয়া যাচ্ছে না। বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও সেটি এক্ষেত্রে কাজে লাগছে না।
বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, বংশাণুক্রম নির্ধারণের চিন্তা এবং পারিবারিক ধারাবাহিকতা মেলাতে তৎকালীন সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছিল। সম্পদের উত্তরাধিকার যেন সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে যতটা না ভালো উদ্যোগ হয়েছে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাগ্রহীতারা। অনেকের বাবা-মা মারা যাওয়ায় তাদের জন্মসনদ নিতে যেসব তথ্য দরকার সেগুলো দিতে পারছেন না।
জন্মসনদ কেন গুরুত্বপূর্ণ: যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে গেলে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। তাছাড়া নতুন পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, সরকারি-বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জমি রেজিস্ট্রেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র, লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিসহ প্রায় ১৮ রকম নাগরিক সেবা মেলে জন্মসনদে।
মৃত্যুসনদ কেন গুরুত্বপূর্ণ : সাকসেশন সনদ, পারিবারিক পেনশন প্রাপ্তি, মৃত ব্যক্তির লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দাবি, নামজারি ও জমাভাগ প্রাপ্তিসহ আরও অনেক সেবা মৃত্যুসনদের ওপর নির্ভর করে।
জানা গেছে, নতুন নিয়ম জারির পর জন্মসনদ নিতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তির কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। পরে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই থেকে কিছু দিনের জন্য জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে বাবা-মায়ের জন্মসনদ চাওয়ার অপশন বন্ধ করে দেয় সরকার। এতে মাঝখানে কিছু দিন সব ঠিকঠাক চলছিল। তবে ওই সময় সার্ভার সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সেবাগ্রহীতারা। এরপর আবার কোন যুক্তিতে বাবা-মায়ের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তার সঠিক জবাব রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে নেই।
সন্তানের জন্মসনদের জন্য বাবা-মায়ের সনদ কেন বাধ্যতামূলক এই প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের। তারা বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট থাকার পরও কেন জন্মসনদ লাগবে। রাষ্ট্রীয় তথ্যভান্ডারে যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের তথ্য রয়েছে, সেখানে কেন জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেই প্রশ্ন সেবাগ্রহীতাদের।
এদিকে, নানা হয়রানি ও ভোগান্তির পর জন্মসনদ মিললেও কোনো কারণে বাবা মায়ের নামের বানান ভুল হলে আরও ভোগান্তি। ভুল সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হয়। সেক্ষেত্রে সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সাবমিট করতে হয়। এগুলো নিয়মের মধ্যে মনে করে মেনে নেন গ্রাহকরা। কিন্তু সংশোধিত কপি নিতে হলে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নয়- দেখার দায়িত্ব জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের। যে কারণে অসংখ্য ভুল জন্মসনদ সংশোধন করতে গিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা গোলাম সাত্তার রনি তার তিন সন্তানের জন্মসনদ সংশোধন করতে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হযেছেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তার তিন ছেলে মীর মোহাম্মদ প্রান্ত, আফিয়া জাহান ও ইয়াসির আরাফাত। প্রত্যেকের জন্মসনদে নাম ইংরেজিতে ঠিক থাকলেও বাংলায় ভুল ছিল। এটি সংশোধনে তিনি প্রথমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উত্তরা আঞ্চলিক অফিসে যান। তারা সমাধান দিতে পারেনি। জানিয়ে দিয়েছে, অনলাইনে আবেদন করতে হবে। সংশোধন কপি অনুমোদনের একমাত্র এখতিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসের। সেখানে একটা আলাদা সেল রয়েছে। তারাই সেটি করেন। পরে ডিসি অফিসে গিয়ে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। হাজার হাজার সেবাগ্রহীতা ভুল সংশোধন করাতে এসেছেন সেখানে। একটা কাজ করাতে গিয়ে সারাদিন লেগে যায়। রনি আরও বলেন, একই ভুল তার নাতির জন্মসনদেও। তার জন্মসনদেও বাংলা বানানে ভুল। এ রকম ছোটখাটো ভুলে চিড়েচ্যাপ্টা সেবাপ্রত্যাশীরা।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নুসরাত জাহান। তার দুই সন্তান সাদমান মুকতাদির ও সালাম মুকতাদিরকে স্কুলে ভর্তি করাবেন। জন্মসনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক কার্যালয় ঘুরে করাতে পারেননি। সন্তানদের জন্মসনদের জন্য বাবা-মায়ের জন্মসনদ দিতে বলেছে সিটি করপোরেশন। অনলাইনে আবেদনই করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘পুরো বিষয়ে বলতে হলে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির আমাদের সময়কে বলেন, আমরা জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে সমন্বয় করে জন্ম ও মৃত্যুসনদ দিচ্ছি। এখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আলাদা কোনো কিছু নেই। সার্ভার সংক্রান্ত বিষয় বা ভোগান্তির বিষয়ে একমাত্র রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় বলতে পারবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরীর ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com