সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের : আ’লীগের সঙ্গে থাকলেও অপরাধ করিনি
গত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলেও অপরাধ করেননি বলে দাবি করেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অপরাধ করিনি। অপরাধী বানানো হচ্ছে। আমাদের আওয়ামী লীগের সহযোগী বলা হচ্ছে, এ ধরনের অন্যায় অপবাদ মানব না।’
জি এম কাদের জানিয়েছিলেন, নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে শনিবার কাকরাইলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ হবেই। ভয় না পেয়ে নেতাকর্মীকে সেখানে জমায়েত হতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কাকরাইল-বিজয়নগর এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার পর পিছিয়ে যায় জাপা। জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সমকালকে বলেছেন, কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক জনতা’র ব্যানারে বৃহস্পতিবার জাপা কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে গতকাল রাত পর্যন্ত সরকারের তরফে বক্তব্য আসেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ হামলার আগে ফেসবুকে ‘এবার এই জাতীয় বেইমানদের উৎখাত নিশ্চিত’ হুঁশিয়ারি দিলেও সংগঠনটির নেতারা বলছেন, যা হয়েছে তা কয়েকজন ব্যক্তির ব্যাপার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সম্পৃক্ত নয়। হামলার ঘটনার রাতে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে জাপা।
বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের আবারও ফিরিস্তি দেন শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাঁর এবং জাপার কী অবদান ছিল। তিনি বলেন, প্রতিদিন নামাজ পড়েছি, দোয়া করেছি। সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছি আন্দোলনকে সফল করতে। প্রতিদিন বিবৃতি দিয়েছি। সেই সময়ে বিবৃতি দেওয়াও ঝুঁকি হতে পারত।
আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে আরও কয়েকটি দল অংশ নিলেও শুধু জাপার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে জি এম কাদের বলেন, ‘দেশের ভালোর জন্য আমরা জীবন দেব’। নেতাকর্মীর উদ্দেশে বলেন, ‘প্রয়োজনে আমরা মরতে প্রস্তুত। কতজনকে তারা মারে, আমরা দেখতে চাই।’ দলীয় কার্যালয়ে হামলাকে অনাকাঙ্ক্ষিত আখ্যা দিয়ে কাদের বলেন, ছাত্র-জনতার নামে কিছু মানুষ আসে হামলা করতে।
কার্যালয়ে থাকা কর্মীরা তাদের প্রতিহত করে ফিরিয়ে দেয়। পরে আবার সংঘবদ্ধভাবে এসে আগুনে দেয়।
ছাত্রনেতাদের অভিযোগ, ১৫-২০ যুবক ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করলে জাপা কার্যালয় থেকে অস্ত্র নিয়ে হামলা হয়। এর প্রতিবাদে ‘ছাত্র-শ্রমিক-জনতা’ জাপা কার্যালয়ে গিয়ে পাল্টা হামলা করে। তা নাকচ করে জি এম কাদের বলেছেন, ছাত্র অধিকার পরিষদের এক নেতার নেতৃত্বে হামলা হয়। ২৯ অক্টোবর রাতেও মশিউর, আনোয়ার ও ইসমাইলের নেতৃত্বে ভাঙচুর হয়।
২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করা জাপা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ‘ডামি নির্বাচনে’ অংশ নেয়। ২০১৮ সালের ‘মধ্যরাতের’ নির্বাচনে বিএনপির তিন গুণ আসন পায়। সেবার জাপার ১৮ এমপিই ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পান! গত তিন সংসদের বিরোধী দল জাপা দশম সংসদে সরকারেরও অংশ ছিল। এতে দলটি গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা পায়।
দলটির এই ভূমিকার জন্য ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ছাত্র নেতৃত্ব জাপাকে পতিত স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা দিয়ে বিচার দাবি করছে। ৫ আগস্ট সেনাসদর এবং বঙ্গভবনে ডাক পেলেও সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে ছাত্রনেতাদের আপত্তিতে আমন্ত্রণ পায়নি দলটি।
জি এম কাদের বলেন, বলা হচ্ছে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দোসর। সে হিসেবে সব অপকর্মের জন্য আমরা দায়ী, যার কোনো সত্যতা নেই। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেছিলাম। সেই নির্বাচন ছিল পৃথিবীময় গ্রহণযোগ্য। সেবার শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলাম। কিন্তু তাঁর কোনো অপকর্মে ছিলাম না।
মন্ত্রিত্ব ছাড়তে চেয়েছিলেন দাবি করে জি এম কাদের বলেন, পুরোনো উড়োজাহাজ দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা, যা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিমানমন্ত্রী হিসেবে নতুন উড়োজাহাজ আনার চেষ্টা করেছিলাম। যখন প্রধানমন্ত্রী জবরদস্তি করেছিলেন, তখন পদত্যাগের চেষ্টা করেছিলাম। কাজেই শেখ হাসিনার জনবিরোধী, অনৈতিক কাজে একাত্ম ছিলাম না।
২০১৪ এবং ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সাফাই গেয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার সময় বিএনপি এবং প্রায় সব দল স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তারা বৈধতা দেয়নি? খালি জাতীয় পার্টি একাই দিয়েছে? বৈধতার প্রশ্ন যদি করেন, আইনগতভাবে বৈধ নির্বাচন হয়েছে। আইনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অপরাধ নয়।’
২০২৪ সালে জাতীয় পার্টিকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে নির্বাচনে নেওয়া হয় বলে আবারও দাবি করেছেন জি এম কাদের। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টিকে ভাগ করা হয়েছে। একটি অংশ সরকারি মদদে সব সুবিধা নিয়েছে, সে কারণেই জাতীয় পার্টি আজ ভিকটিম।
সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদেরের পাশে ছিলেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। যদিও জি এম কাদের সেই নির্বাচনে জাপার অংশগ্রহণের জন্য বারবার রওশনপন্থিদের দায়ী করছেন।
বিএনপির সমালোচনা করে জি এম কাদের বলেছেন, তারা ক্ষমতায় এসে পর পর চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। একটি ভবনে সমান্তরাল প্রশাসন গঠন করে। র্যাব গঠনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করে জি এম কাদের বলেন, ‘অনেক আশা করে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। আন্দোলনের ফসল কি পাচ্ছি? দেশ বিভক্ত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, কিছু লোক দেশ দখল করে ফেলেছে। কে দোষী, কে নির্দোষ, তারাই ঠিক করছে। শেখ হাসিনাও এভাবে দেশকে বিভক্ত করেছিলেন।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে জি এম কাদের বলেন, আপনি অভিভাবক। আপনি আমাদের সবাইকে সমান চোখে দেখেন। দোষ-ত্রুটি সবার আছে। যদি দোষ থাকে, তাহলে বিচার করে শাস্তি দেন।
‘এটা কোন ধরনের রাজনীতি?’
গতকাল বিকেলে দেখা যায়, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে জাপার কার্যালয়ে কিছুই অবশিষ্ট নেই। তা দেখে নেতাকর্মীর কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। একজন প্রশ্ন করেন– ‘এটা কোন ধরনের রাজনীতি?’ আরেকজন বলেন– ‘এইগুলা ঠিক না। দেশে কি কোনো বিচার নাই?’ তবে নাম প্রকাশে রাজি হননি তিনি।
কার্যালয়ের সামনে দেখা যায়, নেতাকর্মীরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করছেন। রাস্তার অপর পাশে পিকআপ ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। এর মধ্যে দলটির এক নেতা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে সেখানে ভিড় জমে। তখন পুলিশ সরে যেতে বললে, কার্যালয়ের সামনের লোকজন সরে যান। নেতাকর্মীর গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা করণীয় নির্ধারণ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন।
পাঁচ তলা কার্যালয়ের নিচতলায় দেখা গেল পুড়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া শাটার, ভাঙা প্লাস্টিকের পাইপ পড়ে আছে। আরেক পাশে অর্ধগলিত টায়ার। বাকি সব ছাই হয়ে গেছে। কার্যালয়ের সামনের দেয়ালে দলের প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়েছে। সাইনবোর্ডটিও ক্ষতবিক্ষত।
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জনা বিশেক নেতাকর্মী স্লোগান দেন সন্ত্রাসীদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও; পার্টি অফিসে হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই; বাঁচতে হলে লড়তে হবে, এ লড়াইয়ে জিততে হবে; এ লড়াইয়ে জিতবে কারা, এরশাদের সৈনিকেরা। তাদের মিছিলটি কিছুটা সামনে গিয়ে আবারও দলীয় কার্যালয়ের সামনে ফিরে আসে।
পুরো সময় পুলিশ সদস্যদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়। সেখানে কর্তব্যরত এসআই মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, টহল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা এখানে অবস্থান করছি।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com