বাজারে গেড়ে বসে আছে সেই অনিয়ম-সিন্ডিকেট
দেশ সংস্কারে নানা খাতে নজর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থনীতির বড় সংকট উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে জোর দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধে উদ্যোগ, পণ্যের যৌক্তিক দাম বেঁধে দেওয়া, পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে শুল্ক কমানো, ডিম আমদানি শুরু করা, টিসিবির পণ্য বিক্রি বাড়ানো, পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে স্বস্তির দেখা মিলছে না কিছুতেই।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সবজিসহ বেশকিছু পণ্যের দাম রাতারাতি কমে আসে। কিন্তু তা ছিল খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। কদিন পরই আগের চিত্রে ফিরে আসে বাজার। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক ও বাজারে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন পণ্যে অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রগুলো ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরনো চক্রগুলো বাজারে গেঁড়ে বসেছে। চাহিদা-জোগানের সূত্র কিংবা ক্রয়মূল্যের ওপর ভিত্তি করে দাম কমছে-বাড়ছে না। অসাধুরা আগের কায়দায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এর চড়া মাশুল গুনতে হচ্ছে ভোক্তাকে; সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন দিন দিন হয়ে পড়ছে দুর্বিষহ।
মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এখন সর্বাধিক আলোচিত ভোগ্যপণ্যটি হচ্ছে ডিম। প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস হিসেবে পরিচিত পণ্যটির দাম শুধু বাড়ছেই। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের বাদামি ডিমের দাম ১৫০ টাকা থেকে লাফিয়ে বেড়ে ১৮০ টাকা হয়েছে। এ দামে কিনে খেতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ। বন্যার কারণে সংকট দেখিয়ে সরবরাহকারীরা দফায় দফায় এর দাম বাড়িয়েছেন। অথচ খোদ খামারিরা বলছেন, বন্যার কারণে সরবরাহ কমলেও বাজারে সংকট হওয়ার কথা নয়; দামও এতটা বাড়ার কথা নয়। অন্যদিকে বাজারে ডিমের সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানি করা হচ্ছে এবং আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। সরকার যেখানে খুচরায় প্রতিটি ডিমের যৌক্তিক মূল্য ১১ টাকা ৮৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেখানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা পর্যন্ত। একই দশা মুরগির বাজারেও।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারের কোনো কিছুই বদলায়নি। চাঁদাবাজি চলছে, পণ্যের দামও অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে সরবরাহকারীরা। বন্যার প্রভাবে ডিমের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন তারা।
বন্যার অজুহাতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে এর সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেট মাত্র ২০ দিনে ২৮০ কোটি টাকা লুট করে নিয়েছেÑ এমন অভিযোগ করছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। সংগঠনটির সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার আমাদের সময়কে বলেন, এ খাতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ী সমিতিগুলোও আড়ালে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে এক পিস ডিমের দাম ১২ থেকে সাড়ে ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়Ñ বলেন তিনি।
শুধু ডিম কিংবা মুরগি নয়। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যে গেঁড়ে বসে আছে পুরনো সিন্ডিকেট। অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রগুলো যে কোনো অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে মরিয়া। আর বাজারে জিম্মি হয়ে আছেন ভোক্তারা।
বাজারে সুষম প্রতিযোগিতার অনেক ঘাটতি থাকায় কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী চক্র পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার মওকা পাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বাজারে কিছুই বদলাচ্ছে না। হয়তো খেলোয়াড় বদলাচ্ছে। আমাদের বাজারে দেখতে পাই, নতুনরা কিংবা ছোটরা ব্যবসায় পেরে উঠছেন না। হাতেগোনা কয়েকটি বড় খেলোয়াড়ই খেলছেন। তাদের হাতেই বাজারের নিয়ন্ত্রণ। এটা হলে এমন পরিস্থিতিই সৃষ্টি হবে। বাজারে এসব বড় খেলোয়াড়ের প্রভাব কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুনরা যাতে প্রতিযোগিতা করতে পারে, তেমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় যেসব ত্রুটি রয়েছে, সেসব দূর করতে হবে।
ড. জাহিদ আরও বলেন, পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির আরেক কারণ চাঁদাবাজি। আমরা দেখলাম, অন্তর্বর্তী সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে এটা বন্ধ হয়ে গেল। সবজিসহ আরও অনেক পণ্যের দাম কমে এলো। অথচ সেটা ধরে রাখতে পারলাম না। সেখানেও খেলা একই, শুধু খেলোয়াড়ের বদল হলো। চাঁদাবাজি বন্ধের যে সুুযোগ তৈরি হয়েছিল, সেটা ধরে রাখতে না পারাটা বর্তমান সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা।
রাজধানীর একাধিক বাজারের সবজি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তারাও জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং এতে ব্যবসায়ীদের ‘হিডেন কস্ট’ কমে এসেছিল। যার ফলে কাঁচাপণ্যের দামও রাতারাতি কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে, যা পণ্যের দামেও যুক্ত হচ্ছে। ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে বন্যার অজুহাতে ডিমের মতো চালের দামও অত্যধিক হারে বেড়ে যায়, যা আর কমেনি। ৬২ থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হওয়া সরু চাল এখন ৭২ থেকে ৭৪ টাকা। মধ্যবিত্তের চাল হিসেবে পরিচিত মাঝারি আটাশ চালের দাম ৬০ টাকা ছাড়িয়েছে এবং গরিবের মোটা চাল ৫৫ টাকায় গিয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আবু ইউসুফ বাচ্চু মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বন্যাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বন্যায় অসংখ্য মিলে ধান ও চাল নষ্ট হয়েছে। এতে সরবরাহ কমেছে। তা ছাড়া ত্রাণ কর্মসূচির ফলে চাহিদায় চাপ বেড়েছিল।
অথচ কারওয়ানবাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাজারে কিছুই বদলায়নি। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে প্রথম দাম বাড়ে। তার দেখাদেখি অন্য বাজারগুলোতেও বেড়ে যায়। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আগে দাম বাড়ায়। পরে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়িয়ে দেয়।
অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম যখন আকাশচুম্বী তখন পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ শিথিল ও শুল্ক কমানোর খবর আশে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। কম শুল্কের পেঁয়াজ দেশে ঢুকলেও বাজারে স্বস্তি ফেরেনি। দোকানভেদে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম এখনও শতের ওপর রয়েছে।
কথা হলে শ্যামবাজারের পাইকারি বিক্রেতা কানাই সাহা জানান, এখনও বাজারে কমিশন বাণিজ্য চলে। ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে নয়, মোবাইলে বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী বিক্রি হয় এবং সেখান থেকে বিক্রেতারা একটা নির্দিষ্ট কমিশন পান।
দেশে আলুর ভালো উৎপাদনের পর কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি আলু ১৫ টাকা দরে কিনে মজুদ করা হলেও তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ কেনা দামের চেয়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। কিছুদিন আগে এ ব্যবধান আরও বেশি ছিল।
বাজারে পণ্য বিক্রিতে নানা অনিয়ম ও কারসাজির তথ্য বেরিয়ে আসছে সরকারি সংস্থার তদারকি অভিযানেও। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তদারকি অভিযানে মিলছে কারসাজির প্রমাণ। অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার ম-ল আমাদের সময়কে বলেন, শুধু ডিম নয়, প্রতিটি পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো পাকা রসিদ, এমনকি পণ্য মজুদের রেজিস্টারও সংরক্ষণ করছেন না। অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত লাভে পণ্য বিক্রি করছেন। আর নেপথ্য থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে অসাধু চক্রও সক্রিয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের জনবল খুবই কম। একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এরপরও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বাজারের এমন পরিস্থিতি এবং সরবরাহ তদারক ও পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। প্রতিটি জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের এ টাস্কফোর্সে দুজন করে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিও থাকবেন।
বাজার বিশ্লেষক ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা ইতিবাচক। আমি মনে করি আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। কিন্তু বাজারের দিকেও নজর দিতে হবে। এরও আগে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন করতে হবে। না হলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তিনি বলেন, টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে যা ভালো বিষয়। কিন্তু টাস্কফোর্স সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে মাত্র, রোগের উপসর্গ খুঁজে বের করার মতো। কিন্তু সমস্যার প্রতিকার নিয়েও ভাবতে হবে।
টাস্কফোর্স কতটা ফলপ্রসূ হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন রেখে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এটা কীভাবে কাজ করবে কিংবা ঠিক কী সুফল বয়ে আনবে, তা বলা যাচ্ছে না। তারা (টাস্কফোর্স) কি পুলিশিং, গ্রেপ্তার বা শাস্তি দিতে পারবে? তা ছাড়া এ ধরনের পুলিশিংয়ের কারণে পণ্যের বাজার নষ্টও হতে পারে। অর্থাৎ হিতে বিপরীত হতে পারে।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com