নদী সাঁতরে, পাহাড় ডিঙিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা : বায়োমেট্রিক ও নিবন্ধনের বাইরে ‘নতুন রোহিঙ্গারা’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও যুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সেখানে অনেক রোহিঙ্গার বসবাস। জান্তা সরকার সেখানে আরাকান আর্মির কাছে পরাস্ত হওয়ার পর চাপে পড়ে রোহিঙ্গারা। অনেকের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতে মংডু ছেড়ে অনেক রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। অনেকে এপারে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের আত্মীয়স্বজন ও পূর্বপরিচিতদের বাসায় উঠছে। আবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির, তারা ক্যাম্পে না উঠে টেকনাফ ও উখিয়ায় বাসা ভাড়া করে বসবাস শুরু করেছে।
এই পরিস্থিতিতে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে, তাদের এখনও বায়োমেট্রিক হয়নি। তাদের নিবন্ধন না করায় সঠিক হিসাব জানা যাচ্ছে না। আগামী মঙ্গলবার রোহিঙ্গাবিষয়ক ন্যাশনাল টাস্কফোর্সের (এনটিএফ) বৈঠক হবে। নতুন করে যেসব রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, ওই বৈঠকে তাদের বায়োমেট্রিকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। এর পর নিবন্ধনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নিয়ে আগে থেকেই নানামুখী সংকটে বাংলাদেশ। অনেক দেনদরবারের পরও তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপি) আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তবে প্রতি বছরই প্রতিশ্রুত সহায়তার চেয়ে বরাদ্দ কম আসছে। এমন বাস্তবতায় নতুনভাবে রোহিঙ্গা প্রবেশ বাংলাদেশের জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর সাম্প্রতিক মাসগুলোয় নতুন করে ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। মিসরের রাজধানী কায়রোয় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী ড. জাম্বরি আব্দুল কাদির সাক্ষাৎ করলে তিনি এ তথ্য জানান।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, আরাকান আর্মি মংডুকেন্দ্রিক আক্রমণ জোরদার করার পর থেকেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশ কিছুটা বেড়েছে। কারণ মংডু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত। সেখানে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সংঘাত ঘিরে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। এই সংখ্যা ৮০ হাজার কিনা, আমরা এখনও নিশ্চিত নই। ‘হেড কাউন্ট’ করে ৫০ হাজারের বেশি বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, এনটিএফের বৈঠকে তাদের বায়োমেট্রিকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিল হয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে সহয়তা করবে– এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ জান্তা সরকারের হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনে সংকট আরও বাড়ল। আশু এটা কাটবে– এমন লক্ষণ নেই। আবার যেসব সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে পরাজিত হয়ে পালিয়েছে, তাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জোর শঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নাফ নদে কড়াকড়ি পাহারা থাকায় পাহাড়ি পথে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। রাখাইনে মংডু শহর বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) দখলের পরও কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় সীমান্তে থেমে নেই গোলার বিকট শব্দ। বন্ধ হচ্ছে না বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গা স্রোত। বান্দরবান জেলার পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে এবার রোহিঙ্গার পাশাপাশি মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনও ঢুকছে। ১৮ নভেম্বর বান্দরবানের ঘুমধুম বাইশফাঁড়ি সীমান্ত দিয়ে তঞ্চংগ্যা ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের অর্ধশতাধিক মিয়ানমারের নাগরিক অনুপ্রবেশ করে উখিয়ায় অবস্থান করছিল।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতভর টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন সীমান্তে একের পর এক গোলার বিকট শব্দ শুনেছেন লোকজন। এদিকে গত ২৯ নভেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু পশিচমকুলের সীমান্তের কাঁটাতার লাগোয়া ওপারে ঢুরি নামক স্থানে প্রায় আড়াইশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে– এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মিয়ানমার সীমান্তে জড়ো হওয়ার কথা উল্লেখ করেন রোহিঙ্গারা। ভিডিওতে জকির নামে একজন দালালের কথা বলেন।
জানা গেছে, বান্দরবান সীমান্তের পাহাড়ি এলাকার নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুম, তুমব্রু, জামছড়ি, লেবুছড়ি, আলী কদম, পশ্চিমকুল সীমান্তে পাহাড়ি অঞ্চলসহ টেকনাফের হোয়াইক্যং ও হ্নীলা এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকছে। এসব সীমান্তে একাধিক দালাল সক্রিয় রয়েছে। তারা ২০-৩০ হাজার টাকা নিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের সহায়তা করছে। মিয়ানমারের দালালের পাশাপাশি একাধিক স্থানীয় দালালও রয়েছে। দালালদের মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের জলপাইতলী এলাকায় জকির আহমদ সিন্ডিকেট প্রধান ও কামরুল হাসান সোহেল, নুরুল আমিন ওরফে মনিয়া, মো. ইসমাইল, মো. ইব্রাহিম, সরওয়ার, দেলোয়ার; বাইশফাঁড়ির জকির আহমদ জাহাঙ্গীর, আলমগীর, শাহ আলম ওরফে রাঙ্গা শাহ আলম, মো. রাসেল, কামরুল হাসান সোহেল, ছৈয়দ আলম, উসিংলা, মংসিং তঞ্চংগ্যা, মোবারকসহ অনেকে রয়েছে।
সীমান্তের বাসিন্দারা জানায়, রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে অনুপ্রবেশ করছে। এমনকি রাতের আঁধারে সাঁতরে বাংলাদেশে আসছে। আবার মংডুতে রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে আরাকান আর্মিও বাণিজ্যে জড়িত। যেসব রোহিঙ্গা তাদের অর্থ দিচ্ছে, তাদের বাংলাদেশ সীমান্তে আসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে তারা।
সীমান্তে বসবাসকারী মোহাম্মদ শাহীন বলেন, দালালরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে নৌকায় রোহিঙ্গাদের এপারে সীমানায় নিয়ে আসে। এর পর সুযোগ মতো গন্তব্যে পাঠায়। দালালদের ধরা না হলে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা কঠিন।
বৃহস্পতিবার রাতভর রাখাইনে গোলার বিকট শব্দে নির্ঘুম কেটেছে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের মানুষের। শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, ভয়ে রাতভর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জড়ো হয়ে বসে থাকতে হয়েছে। সীমান্তে যুদ্ধবিমান চক্কর দিতে দেখা গেছে। টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সৈয়দ আলম বলেন, ‘রাখাইনে যুদ্ধের নামে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হচ্ছে। এখনও মংডু শহরে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। সেখানে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com