ব্যাংকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা জিম্মিকাণ্ড : যৌথ বাহিনীর চেষ্টায় তিন ডাকাতের আত্মসমর্পণ
ক্রেতা-বিক্রেতায় জমজমাট রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার মধ্যপাড়া। অন্যান্য দিনের মতো গতকাল বৃহস্পতিবারও সবকিছু চলছিল স্বাভাবিক। হঠাৎ দুপুর ২টার দিকে পাল্টে যায় চিত্র। খবর ছড়িয়ে পড়ে– রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় ডাকাত হানা দিয়েছে। মসজিদের মাইক থেকেও জানানো হয়। এর পর শত শত মানুষ এসে ব্যাংক ভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে অবস্থান নেয়। দিনদুপুরে এমন জিম্মি ঘটনার খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত ঘিরে ফেলে ব্যাংক ভবনটি। ভেতরের পরিবেশ নিয়ে বাইরে যেমন উৎকণ্ঠা, তেমনি উত্তেজনা। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা যৌথ বাহিনীর সঙ্গে নানামুখী কথা চালাচালির পর তিন ডাকাত আত্মসমর্পণ করলে জিম্মিদশার অবসান হয়। এর পর আত্মসমর্পণ করা এক তরুণ ও দুই কিশোরকে নেওয়া হয় পুলিশ হেফাজতে।
সরেজমিন চুনকুটিয়ায় দেখা যায়, চারতলা ভবনের দোতলায় রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখা। আশপাশে শত শত উৎসুক মানুষ। সেনা, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা কড়া পাহারায়। পরে তিন ডাকাতকে ভিড়ের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় নেওয়া হয়। ডাকাতদের বহনকারী গাড়ির পেছনে ছুটে লোকজন চিৎকার ও হইচই করে।
রূপালী ব্যাংকের শাখা ভবনের ঠিক উল্টো দিকের দোকানি মনির হোসেন সমকালকে বলেন, সকাল থেকে দোকানে ছিলাম। বুঝতেই পারিনি, ব্যাংকে ডাকাত দল ঢুকেছে। মাইকে ঘোষণার পর জেনেছি। এর পর দেখি আশপাশ থেকে শত শত মানুষ ভিড় করছে। অনেকের হাতেই লাঠিসোটা।
বিকেলে তিন ডাকাতকে গাড়িতে নেওয়ার সময় র্যাব ১০-এর অধিনায়ক খালেদুল হক হাওলাদার জানান, প্রথমে তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কথা চালাচালির এক পর্যায়ে তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণে রাজি হয়। ভেতরে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ডাকাতদের একটি গ্রুপ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এক শিশুসহ ছয় গ্রাহক ও ব্যাংকের ১০ জনকে জিম্মি করে মেঝেতে বসিয়ে রাখে। ডাকাতদের মুখে মাস্ক ছিল।
সমকালের হাতে আসা ব্যাংকের ভেতরের একটি ফুটেজে দেখা যায়, মেঝেতে বসে থাকা গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের পাহারা দিচ্ছে ডাকাতরা। এক ডাকাতের পেছনে একটি ব্যাগ ছিল; চেয়ারে বসা। আরেকজন দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর রাখছিল। ভিডিওতে বাকি ডাকাতকে দেখা যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় জানানো হয়। ঘটনার সময় পুলিশের একটি টহল দলও চুনকুটিয়ার কাছাকাছি ছিল। তথ্য পেয়ে তারাও দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। ডাকাত চক্রের সদস্যরা ভেতর থেকে ফোন করে খাবার চায়।
এর পর তাদের জন্য চিপস, বিস্কুট পাঠানো হয়। যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যখন তাদের কথোপকথন চলছিল, তাদের প্রথমে অস্ত্র সমর্পণ করতে বলা হয়। এ সময় তিনজন নিজেদের নীরব, নিলয় ও নিবিড় বলে পরিচয় দেয়।
ডাকাতরা চিরকুটের মাধ্যমে তাদের মোবাইল নম্বর দিয়েছিল। সেই নম্বরে ডাকাতদের সঙ্গে কথা বলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে তারা আত্মসমর্পণে রাজি হয় এবং জানালা দিয়ে অস্ত্র ফেলে দেয়। এর মধ্যে একটি বন্দুক জানালা দিয়ে ফেলা হয়। আর বাকি অস্ত্র ব্যাগে ভরে ফেলা হয়। ব্যাংকে ঢুকে গ্রাহকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ধরে রাখে ডাকাত দলের এক সদস্য। এর পর আরও একজন পিস্তল হাতে নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা তিনটি ব্যাগের একটিতে টাকা ভরতে থাকে। এ সময় ডাকাত দলের তিন সদস্যের একজন ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ব্যাংকের কাউন্টার থেকে নগদ ১৫ লাখ টাকা লুট করে একটি ব্যাগে রাখে। একই সঙ্গে আরও তিন লাখ টাকা তিনজনের প্যান্টের পকেটে রাখে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রূপালী ব্যাংকে ঢুকে পড়া ডাকাতরা দুটি শর্ত দিয়েছিল– ১৫ লাখ টাকা ও নিরাপদ স্থানে ছেড়ে দিতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুল হাসান ভুঁইয়া বলেন, প্রায় এলাকাতেই চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের টহল তেমন না থাকায় দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া।
বৃহস্পতিবার রাতে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ বলেন, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় যে তিনজন ডাকাতি করতে আসে, তাদের দু’জন কিশোর, একজন তরুণ। একজনের বয়স ২২; অন্য দু’জনের ১৬ বছর। তারা কোনো চলচ্চিত্র বা ভিডিও গেমস দেখে একটি ফ্যান্টাসিতে ভুগে এ কাজ ঘটিয়েছে। তারা ১৮ লাখ টাকা ব্যাগে নিয়েছিল। এ টাকা দিয়ে একজন কিডনি রোগীকে সাহায্য করার কথা জানিয়েছে। পাশাপাশি আইফোন কেনার পরিকল্পনা ছিল বলে জানিয়েছে। তারা যে রোগীর ঠিকানা দিয়েছে, সেটি যাচাই-বাছাই চলছে। আদৌ সত্য কিনা, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
তিনি আরও বলেন, তাদের অপরাধী বলা যায় না। তারা হয়তো মিস গাইডেড। তারা অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে হয়তো এ ডাকাতি করতে আসে। মুভি দেখে এমন একটি অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে ডাকাতি করতে এসেছিল বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।
অভিযান বিষয়ে এসপি আহম্মদ মুঈদ বলেন, ঘটনার শুরু থেকেই আইজিপি লাইভে এসে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন– কোনো হতাহতের ঘটনা ছাড়াই যেন অভিযান শেষ হয়। এ জন্য ডাকাতদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলেছি। আইজিপি স্যারের সঙ্গেও ডাকাতদের কথা বলিয়ে দেওয়া হয়।
বাইরে ডাকাত দলের কেউ ছিল কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনজন ছাড়া বাইরে কেউ ছিল না। তবে তারা প্রাথমিকভাবে আমাদের বলেছিল, বাইরেও তাদের লোক আছে। পুলিশকে ভয় দেখানোর জন্য বলেছিল মনে হয়।’
ব্যাংকে ঢোকার পরের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মুঈদ বলেন, ‘ব্যাংকের যে সিকিউরিটি গার্ড সিটে ছিল না; ওই সময় আরেকজন পিয়নকে তার চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। ওরা যেহেতু আর্মস নিয়ে ঢুকেছে, টিনেজ; সবাই ভয় পেয়েছে। সবাইকে হেডডাউন করতে বলেছিল। পরে ওরা ভেতরে আটকা পড়ে যায়। কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততা আছে কিনা; এদের কোনো ‘বড়ভাই’ গাইড করেছে কিনা– এসব খতিয়ে দেখবে পুলিশ।
রাত সাড়ে ৭টার দিকে ব্যাংক পরিদর্শন শেষে রূপালী ব্যাংকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের জিএম ইসমাইল হোসেন শেখ বলেন, ব্যাংক থেকে জনগণের কোনো আমানত খোয়া যায়নি। রোববার থেকে ব্যাংকের এ শাখায় আবার আগের মতো লেনদেন হবে। ডাকাতরা হানা দেওয়ার সময় ব্যাংকে মোট ছয় গ্রাহক ছিলেন। তারা নিরাপদে আছেন। সে সময় ব্যাংকে ছিলেন সাত কর্মকর্তা, এক অফিস সহকারী ও দু’জন ফায়ার গার্ড। গ্রাহক সেজে তারা ব্যাংকে ঢুকেছিল।
পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে তিনজন তাদের নাম আরাফাত (১৬), নিলয় মোল্লা নীরব (২২) ও সিফাত (১৬) বলেছে। নামগুলো সঠিক কিনা, যাচাই করা হচ্ছে। নীরব পেশায় গাড়িচালক। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর কুমুরিয়া গ্রামে। অন্য দু’জন শিক্ষার্থী। তারা কেরানীগঞ্জের কদমতলী এলাকার বাসিন্দা। তাদের কাছ থেকে চারটি খেলনা পিস্তল, দুটি চাকু, একটি লোহার পাইপ, একটি স্কুলব্যাগ, তিনটি মাস্ক, তিন জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস ও তিনটি কালো চশমা উদ্ধার করা হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com