ছাগলকাণ্ডের মতিউরের সাথে ফোনালাপ ফাঁস : সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এনবিআরের আরজিনা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (মূসক মনিটরিং, পরিসংখ্যান ও সমন্বয়) বিভাগের দ্বিতীয় সচিব হিসেবে আরজিনা খাতুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত থাকাকালীন কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন। এসব অর্থে ঢাকা ও রাজবাড়ীতে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) গত ১০ জুন এমন অভিযোগ দায়ের করেছেন ফেয়ার অ্যান্ড সন্স কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে মো. ইসতিয়াক আহমেদ রেজা নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগটি এখন অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। এদিকে ছাগলকাণ্ডের জেরে ফেঁসে যাওয়া মতিউর রহমানের সঙ্গে আরজিনার সখ্যতা ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে রাজবাড়ীতে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
দুদকে ইসতিয়াক আহমেদের দাখিলকৃত অভিযোগে বলা হয়েছেÑ আমদানি পণ্য খালাসের নামে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন আরজিনা। অনেক সময় পণ্য খালাসের কাজ না হলেও সেই টাকা আর ফেরত দিতেন না। এভাবে দুর্নীতির টাকায় তিনি গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। একইসঙ্গে তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি টাকার স্বর্ণ।
আরজিনা খাতুন আগে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের উপকমিশনার ছিলেন। এক বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) বদলি করা হয় তাকে। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামে থাকাকালীন তার ঘুষের টাকা লেনদেনের বাহক ছিলেন তার বন্ধু আবু তাহের, অফিসের পিয়ন মো. ইলিয়াস ও গাড়িচালক শাহাজাহান আকতার।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার তালুকপাড়ার গ্রামের আহমেদ আলীর মেয়ে আরজিনা খাতুন। তার বিরুদ্ধে দুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থে ৫০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন আরজিনা খাতুন। তার বার্ষিক আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন, বিয়ের সময় ১০০ ভরি স্বর্ণ উপহার পেয়েছেন। কিন্তু তার বিয়ের কাবিননামায় এসব স্বর্ণের কথা উল্লেখ নেই।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা ১০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন রয়েল ঢাকার মালাবার দোকান থেকে। বাকি ৩০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন ঢাকার আপন জুয়েলার্স ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড থেকে। বর্তমানে এসব স্বর্ণের মূল্য অন্তত ৬ কোটি টাকা। দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লকারে ও ক্রয়কৃত দোকানে স্বর্ণগুলো বন্ধক রেখেছেন তিনি।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ক্রয়মূল্য গোপন করে ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা। বাস্তবে তিনি ফ্ল্যাটটি কিনেছেন ২ কোটি টাকায়। কিন্তু চুক্তিনামায় উল্লেখ করেছেন ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ফ্ল্যাট কেনার এক বছর পর। এছাড়া ফ্ল্যাট কেনার পর সেখানে ইনটেরিয়র ডিজাইনের পেছনে খরচ করেছেন ২৭ লাখ টাকা, ফ্ল্যাটের ইলেক্ট্রনিকস ও ফার্নিচারের পেছনে ব্যয় করেছেন ৩৫ লাখ টাকা।
আরজিনার নিজস্ব একটি প্রাইভেট কার রয়েছে, যার নম্বর গ-১৬-৭৪৫৮। ওই কারটি নিজের অর্থ দিয়ে কেনা হলেও কারটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ‘আনবি লজিস্টিক লিমিটেডের‘ নামে রেজিস্ট্রেশন করানো হয়। ওই সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীও কাস্টমস কর্মকর্তার সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
দুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কাস্টমসের চাকরির আগে আরজিনা খাতুনের বাড়ি ছিল ২০ ফিটের একটি টিনের ঘর। ওই টিনের ঘরের একটি অংশ পার্টিশন দেওয়া ছিল। সম্প্রতি তার গ্রামের বাড়িতে ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। ফার্নিচার ও ইলেক্ট্রনিক্স খাতে ব্যয় করা হয়েছে আরও অন্তত ৩৫ লাখ টাকা।
অভিযোগে বলা হয়, আরজিনার বাল্যবন্ধু হিসেবে সবার কাছে পরিচিত একই গ্রামের মো. আবু তাহের। তিনি এয়ারপোর্ট-সংলগ্ন কাওলায় ব্যবসা করেন। আরজিনা চট্টগ্রাম কাস্টমসে থাকাকালীন পিয়ন ইলিয়াস ও তার গাড়িচালক শাহজাহান আকতারকে দিয়ে টাকা পাঠাতেন দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। একটি নিরো এন্টারপ্রাইজ, অপরটি বেঙ্গল ট্রেডিংয়ের নামে। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডে অ্যাকাউন্টগুলো রয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা তার বাবা আলী আহমেদের কাছে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি এলাকায় সোনালী ব্যাংক এবং মা বাবার বিকাশে টাকা পাঠাতেন। শুধু তাই নয়, ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তার আপন দুই ছোট ভাইয়ের নামে ৪০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন আরজিনা। বর্তমানে সেখান থেকে ৩০ বিঘা জমি বন্ধক রাখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় অভিযোগে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আরজিনার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের তালুকপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেই টিনের ঘরটি এখন আর নেই। সেখানে আলিসান বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। তার বাড়িতে গেলেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
তালুকপাড়া গ্রামের বেশ কয়েকজন বলেন, আহম্মদ আলী একজন দিনমজুর। মাছ শিকার ও চাষাবাদ করে সংসার চলত তার। দুই ছেলে, এক মেয়ে তার। দুই ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। আর মেয়ে আরজিনা খাতুন অল্প দিনেই অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছেন। নারুয়া বাজারে জমি ক্রয় করে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। বালিয়াকান্দি শহরে ও রাজবাড়ী শহরে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। মাঠে ১০ থেকে ১২ পাখি (২২ শতাংশে এক পাখি) জমি ক্রয় করেছেন। গ্রামবাসীরা বলেন, ব্যাংকে এ পরিবারের কোনো টাকা আছে কিনা, বলতে পারব না। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এ পরিবারের আর্থিক অবস্থা ব্যাপক পাল্টে গেছে।
নারুয়া বাজারে জমি ক্রয় করে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন আরজু নামে এক ব্যবসায়ীর নিকট। আরজু বলেন, আরজিনা খাতুনের ভাই মতিন ও মেহের সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। মতিন মিশনে যাওয়ার পর দেশে এসে বাজারের জমি ক্রয় করে টিনের ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। এটা আরজিনার কি না, বলতে পারব না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাহেন্দ্র চালক বলেন, আরজিনা খাতুনের মাকে একটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে তার ৭০ হাজার টাকা মূল্যের একটি স্বর্ণের চেইন হারিয়ে যায়। পরে আরজিনাকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ও নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই, এটা আমার ১ মিনিটের কামাইয়ের সমান নয়।
আব্দুল আলিম নামে এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা শুনছি। ছাগলকাণ্ডের মতিউরের সাথে তার নাকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মাত্র ৩ বছরে এত সম্পদ হয়েছে আরজিনার। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত আরজিনা খাতুনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ মিথ্যা ও কাল্পনিক উল্লেখ করে বলেন, তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার পর থেকেই এভাবে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে। তিনি এ বিষয়ে মামলা করেছেন। আরজিনা বলেন, আমি এখন চরম অশান্তির মধ্যে রয়েছি। দুদক থেকে তাকে তলব করা হলে তিনি জবাব দেবেন বলেও জানান এই সরকারি কর্মকর্তা।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com