মোঃ কাজিম উদ্দিন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিঃ
১. ব্যাংক ও বীমা দেশের অন্যতম আর্থিক খাত হলেও শুধু বীমা খাতে জাতীয় দিবস পালিত হচ্ছে। বীমা কোম্পানীর মুখ্য নির্বাহী হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখেন।
মোঃ কাজিম উদ্দিন: এটা অবশ্যই গর্বের ও সম্মানের। যেকোনো জাতীয় দিবসের সঙ্গে দেশের গৌরব, মর্যাদা এবং সম্মান জড়িত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে বীমা শিল্পকে গৌরবময় এবং মর্যদাপূর্ণ করেছেন। এর মাধ্যমে অবহেলিত বীমা শিল্প একটি সম্মানজনক স্থানে পৌঁছেছে বলে আমি মনে করি। আর এই খাতের একজন কর্মী বলেই বীমা দিবসটি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
২. যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বীমা দিবস পালিত হয় তার বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু ঘটছে?
মোঃ কাজিম উদ্দিন: বীমা খাতের জন্য বীমা দিবসটি বেশ সম্মান ও গৌরবের। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বীমা কোম্পানিগুলো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও আইডিআরএ এর নির্দেশেনায় সারা দেশে সরকারীভাবে বীমা নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য শোভাযাত্রা, লিফলেট বিতরণ, আলোচনা সভাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে বীমা প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ছে। তাই আমি মনে করি, বীমা দিবস পালনের কারণে এ খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
৩. অতীতের তুলনায় বর্তমানে বীমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কী বাড়ছে?
মোঃ কাজিম উদ্দিন: এক সময় বীমা কোম্পানীগুলো প্রিমিয়াম আদায় করতো হাতে লেখা রশিদ দিয়ে। এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহক সেবায় জটিলতা হতো। তবে বর্তমানে সময় বদলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে বীমা কোম্পানিগুলোর কায়ক্রমও ডিজিটাল হচ্ছে। এখন প্রিমিয়াম আদায়ে ডিজিটাল রশিদ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ গ্রাহক প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুঠোফোনে এসএমএস চলে যাচ্ছে। আইডিআরএও এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহকদের পলিসির তথ্য দিচ্ছে। এতে গ্রাহক তার প্রিমিয়াম জমা হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে। ফলে অনাস্থা দূর হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বাসও বাড়ছে।
৪. দেশের জনসংখ্যার তুলনায় জীবন বীমা গ্রাহকের হার অতি নগণ্য। পার্শ্ববর্তী দেশেসহ উন্নত বিশ্বে বীমা গ্রাহকের হার অনেক বেশী। বাংলাদেশের মানুষ বীমা গ্রহণে অনাগ্রহী কেন? মোঃ কাজিম উদ্দিন: বিপুল জনসংখ্যার দেশ হলেও বাংলাদেশে বীমা গ্রাহকের হার অত্যন্ত নগণ্য। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ বীমার আওতায় এসেছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বীমার অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। উন্নত বিশ্বে এই হার শতভাগের কাছাকাছি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জিডিপিতেও বীমার অবদান ৪ দশমিক ২ শতাংশ। নেপাল, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশেও এ হার বেশ সন্তোষজনক। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের বীমা খাত পিছিয়ে থাকার বড় কারণ গ্রাহকের আস্থা ও সচেতনতার অভাব। আরও সহজ করে বললে, বীমার উপকারিতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা এবং বীমা নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রচারণা বা অপপ্রচার এই খাতকে পিছিয়ে রেখেছে। এ কারণে বাংলাদেশে বীমাশিল্পের কাঙ্ক্ষিত প্রসার ঘটেনি। এ জন্য সাধারণ মানুষ বীমা পলিসি গ্রহণে অনাগ্রহী। তবে আশার কথা হলো- সরকার ও আইডিআরএ এর নানামুখী পদক্ষেপের ফলে বীমার প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে বীমা আইন ২০১০ এবং জাতীয় বীমানীতি ২০১৪ প্রণনয়, বীমা কোম্পানিগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সারা দেশে জাতীয় বীমা দিবস পালনের মাধ্যমে বীমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ছে। তবে বীমার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে হলে বীমা কোম্পানিগুলোকে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি ও সময়মত বীমা দাবী পরিশোধ করতে হবে।
৫. সদ্য প্রবর্তিত ব্যাংকাস্যুরেন্সের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কতটুকু দেখছেন?
মোঃ কাজিম উদ্দিন: বাংলাদেশে ব্যাংকাস্যুরেন্সের বিপুল সম্ভাবনা সম্ভাবন রয়েছে। ব্যাংকাসুরেন্স প্রবর্তন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে বীমা জনগণের কাছে আরও সহজলভ্য হবে ও জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা সুবিধা সম্প্রসারিত হবে। বাংলাদেশের বর্তমান ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটি মানুষ প্রাপ্তবয়ষ্ক। কিন্তু এই ১০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে বীমার আওতায় আছে ১ কোটিরও কম। আশা করছি ব্যাংকাসুরেন্সের মাধ্যমে বীমার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে এবং বীমায় পেনিট্রেশন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাংকাসুরেন্সের মাধ্যমে বীমা গ্রহণের হার প্রায় ৫৫% এবং এজেন্সী এবং অন্যান্য চ্যানেলের মাধ্যমে বীমা গ্রহণের হার প্রায় ৪৫%। শুধুমাত্র ভারতের এসবিআই লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০২২ সালের তাদের অর্জিত মোট প্রিমিয়াম ২৯,৫৯০ কোটি রুপির মধ্যে ব্যাংকাসুরেন্সের মাধ্যমে আয় করেছে ১৭,৮৩০ কোটি রুপি, যা তাদের মোট প্রিমিয়ামের ৬০%। আমরাও সার্বিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকাসুরেন্সকে এগিয়ে নিতে পারলে আমাদেরও বিপুল প্রিমিয়াম আয় সম্ভব হবে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৃহৎদাকারভাবে ভূমিকা রাখবে।
৬. বীমা দাবী পরিশোধ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন উল্লেখ করুন?
মোঃ কাজিম উদ্দিন: বীমা দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য বীমা দাবি পরিশোধকে উৎসাহিত করা। বীমা দাবি পরিশোধে শুধু যে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক লাভবান হন তা নয়, বরং এতে পুরো বীমা খাত লাভবান হয়। সঠিক সময়ে বীমা দাবি পরিশোধ করা হলে বীমার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও আস্থা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কোম্পানিগুলোকে মেয়াদ পূর্তির পরই দ্রুত বীমা দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। পদ্ধতিগত কার্যক্রমের নামে সময়ক্ষেপন না করে দ্রুত দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। দাবির চেক প্রদানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা গেলে বীমা নিয়ে নেতিবাচক ধারনা দূর হবে এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে; যা নতুন গ্রাহক সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ন্যাশনাল লাইফ ২০২৩ সালে ১০৯৩ কোটি টাকা দাবী পরিশোধ করে। ফলশ্রুতিতে ২০২৩ সালে আমরা সর্বমোট ১৮৬৪ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয় করতে সক্ষম হয়েছি।
৭. সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী আপনার প্রতিষ্ঠানের সর্বমোট মোট বিক্রিত পলিসির সংখ্যা, গ্রাহকের সংখ্যা, পরিশোধিত দাবীর সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ, দাবি নিষ্পত্তির হার, লাইফ ফান্ড, বর্তমান বিনিয়োগ কত?
মোঃ কাজিম উদ্দিন: ২০২৩ সাল শেষে ন্যাশনাল লাইফের বিক্রিত বীমা পলিাসর সংখ্যা ৬৪ লক্ষ ৫৯ হাজার ৭৩০, সর্বমোট প্রিমিয়াম অর্জিত হয়েছে ১৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, লাইফ ফান্ড ৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, বিনিয়োগ রয়েছে ৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা এবং মোট সম্পদ ৬ হাজার ০৪১ কোটি টাকা। তাছাড়া ২০২৩ সালে সর্বমোট দাবী পরিশোধ করা হয় ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আমাদের লাইফ ফান্ডের ৯৫ শতাংশই সরকারি ট্রেজারি বন্ডে ৩৮% সহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা আছে। কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ় ও গ্রাহকের দাবি পরিশোধের সক্ষমতা বজায় রাখতে গত ৩৯ বছর ধরে লাইফ ফান্ডের টাকা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। অতীতে ন্যাশনাল লাইফে কখনও আর্থিক সংকট দেখা দেয়নি, ভবিষ্যতেও এমন সম্ভাবনা নেই। প্রতি বছরে লাইফ ফান্ড উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য ন্যাশনাল লাইফ আজ সুদৃঢ় আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
৮. বীমা খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মোঃ কাজিম উদ্দিন: বীমা খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিআইএ গঠনের পর থেকে সংগঠনটির বীমা শিল্পের উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছে। ইতোপূর্বে যারা সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন তারা সবাই বীমা শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে বিআইএর বর্তমান প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেনের বিচক্ষণ ও দূরদর্শী চিন্তাচেতনায় বাংলাদেশের বীমা খাত অনেক এগিয়ে গেছে। আইডিআরএ গঠন, নতুন বীমা আইন প্রবর্তন ও জাতীয় বীমা দিবসসহ বীমা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে বিআইএ জড়িত। বিআইএর প্রচেষ্টায় জাতীয় বীমা দিবসে কোম্পানিগুলোকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান বিআইএর অন্যতম অবদান।
৯. বীমা খাতের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে আরও কি ধরণের উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন?
মোঃ কাজিম উদ্দিন: বীমা খাতের সার্বিক উন্নয়নে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে আসছে। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে সংস্থাটির আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে লাইফ বীমা কোম্পানীগুলো লাইফ ফান্ডের টাকা আইডিআরএ এর গাইডলাইন অনুযায়ী সরকারী ট্রেজারী বন্ডে বিনিয়োগ করছে কিনা তা নিশ্চিতকরণে আইডিআরকে বিশেষ তদারকি করতে হবে। লাইফ ফান্ডের টাকা যথাযথ বিনিয়োগ করা হলে বীমা দাবী পরিশোধে কোম্পানীগুলোকে সমস্যায় পড়তে হবেনা। ফলে এখাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, যুগোপযোগী বীমা পরিকল্প প্রণয়নে কোম্পানীগুলোকে নীতি সহায়তা প্রদান, বীমা প্রসারে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করতে হবে ও সকলের জন্য জীবনবীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com