ঢাকা মহানগর দক্ষিণে ছিল বাপ- বেটার ‘কালো ছায়া’
আবু আহমেদ মন্নাফী আর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব। সম্পর্কে বাপ-বেটা। একজন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্যজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত মহানগরীর দক্ষিণ অংশে ছিল এই বাবা-ছেলের ‘কালো ছায়া’। দলীয় পদ-বাণিজ্য, ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ, মাদক কারবার, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ হেন কুকীর্তি নেই, যা তারা করেননি। এসব করে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে তটস্থ থাকতে হয়েছে সাধারণ মানুষ তো বটেই; অনেক প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাকেও।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কাপ্তানবাজার, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ওয়ারী, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মতিঝিল, শাহজাহানপুরসহ বেশ কয়েকটি থানা ঘুরে মিলেছে মন্নাফী ও গৌরবের নানা অপকর্মের তথ্য। আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ডের নেতাকর্মীসহ এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্য সবার মতো পালিয়েছেন মন্নাফী ও গৌরব। তবে এখন তারা দেশে, নাকি বিদেশে– সে বিষয়ে তথ্য দিতে পারেননি দলীয় নেতাকর্মী। এমনকি তাদের স্বজনও জানেন না বাবা-ছেলের বর্তমান অবস্থান।
পারিবারিক বলয়
২০১৬ সালের সম্মেলনে আবু আহমেদ মন্নাফী মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হন। সে সময়ই প্রভাব খাটিয়ে ছোট ছেলে গৌরবকে দলের মহানগর দক্ষিণের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক বানিয়েছিলেন। সে সময় দলীয় কোনো কার্যক্রমে না থাকলেও শুধু বাবার অনুকম্পায় নেতা বনে যান গৌরব।
২০১৯ সালের সম্মেলনে মন্নাফী মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হলে তাঁর প্রভাব আরও বাড়ে। ২০২০ সালের সিটি নির্বাচনে দক্ষিণের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন পান গৌরব। কাউন্সিলর হয়েই এলাকার সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। মন্নাফীও দলীয় কর্মকাণ্ডের পুরোটাই ছেড়ে দিয়েছিলেন ছেলের হাতে। বাবার আশকারায় থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটি থেকে ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে চিহ্নিত অপরাধী, মাদক কারবারি, মামলার আসামি, হাইব্রিড ও বিতর্কিতদের অন্তর্ভুক্ত করে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন গৌরব। তাঁর ইশারা ছাড়া কোনো ইউনিট বা ওয়ার্ড কমিটিতে পদ পাওয়া ছিল বিরল।
নেতাকর্মী জানান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যালয় থাকলেও সেখানে নেতাকর্মীর আনাগোনা ছিল না। সবকিছু চলত কাপ্তানবাজারে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ঘিরে। মধ্যরাত পর্যন্ত ওই কার্যালয় গমগম করত নানা দেনদরবারে। এই বলয়ের বাইরে গিয়ে কোনো নেতাকর্মী প্রতিবাদ করলেই নেমে আসত নির্যাতনের খড়্গ।
যদিও সে সময়ই বাবা-ছেলের অপকর্মের বিরুদ্ধে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মী। তবে অদৃশ্য কারণে বাপ-বেটার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তই হয়নি।
পদ-বাণিজ্যে কয়েক কোটি টাকা পকেটে
২০২২ সালের অক্টোবরে ঢাকা মহানগরীর সব থানা-ওয়ার্ড সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দক্ষিণের ২৪ থানা ও ৭৫ ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি করার দায়িত্ব পান মন্নাফী এবং মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। দায়িত্ব পেয়েই দুই নেতা নেমে পড়েন বেপরোয়া পদ-বাণিজ্যে। এ ক্ষেত্রে মন্নাফী পদ বিক্রির বিষয়টি নতুন মাত্রায় নিয়ে যান।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবিত কমিটি গঠনের নামে মন্নাফী ৫০ লাখ টাকা নিয়ে শাহবাগ থানা কমিটির সভাপতি পদে জি এম আতিকুর রহমান আতিকের নাম প্রস্তাব করেন। একইভাবে করোলা ক্রস গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-২১-৬৩৩১) উপহার নিয়ে রমনা থানার সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম মোস্তফা শিমুল এবং ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে কদমতলী থানার সাধারণ সম্পাদক পদে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিকের নাম প্রস্তাব করেন। অথচ ছয় মামলার আসামি শিমুলের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের আলোচিত যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যা ও ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আতিক ও আকাশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকার বিনিময়ে বিতর্কিত অনেককেই দলীয় পদে প্রস্তাব করেছেন মন্নাফী। আবার ডেমরা থানার নবগঠিত ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি পদে মোহাম্মদ আলীর নাম প্রস্তাবের বিনিময়ে ২০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন তিনি। তবে ত্যাগী এই নেতা টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় বিপুল টাকার বিনিময়ে চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও পারিবারিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত জয়নাল আবেদিন হাজারীকে ওই পদে প্রস্তাব করেন তিনি।
পদ-বাণিজ্য ছাড়াও দলের মধ্যে পরিবারতন্ত্র শক্তিশালী করার চেষ্টায়ও ব্রত ছিলেন মন্নাফী। সে সময় মহানগর দক্ষিণের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি পদে প্রস্তাব করেন ছেলে গৌরবের নাম। আর মতিঝিল থানার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করেন ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরীর নাম। এই ওয়াহিদ তাঁর ছেলে গৌরবের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক সঙ্গী। ওয়াহিদের বিরুদ্ধে দিলকুশাসহ বিভিন্ন এলাকার একাধিক জায়গা দখল ও মাদক কারবারের অভিযোগ রয়েছে।
পদ-বাণিজ্যে ছেলে গৌরবও কম যাননি। ২০২৩ সালের আগস্টে কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের অনুমতির জন্য ওই ইউনিটের নেতারা গিয়েছিলেন মন্নাফীর কাছে। তিনি এ বিষয়ে ছেলে গৌরবের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। এরপর সম্মেলনের মাধ্যমে পদ পাওয়ার আশায় গৌরবকে ২০ লাখ টাকা দেন কদমতলী থানা আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের কপালে পদ জোটেনি।
এদিকে পদ-বাণিজ্য নিয়ে এমন সমালোচনার মধ্যেই গত ১৬ জুন মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের স্বাক্ষরে দক্ষিণ অংশের প্রস্তাবিত থানা-ওয়ার্ড কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে জমা দেওয়া হয়। তবে পদপ্রত্যাশীদের অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে পদ-বাণিজ্যের তথ্যপ্রমাণসহ দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বিষয়টি তদন্ত ও যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেন। অবশ্য এরই মধ্যে ৫ আগস্ট সরকার পতন ঘটায় থানা-ওয়ার্ড কমিটিগুলো আর যাচাই-বাছাই বা ঘোষণাই করা যায়নি।
অপরাধের নিয়ন্ত্রণ গৌরবের হাতে
সে সময় সব ধরনের অপরাধের নিয়ন্ত্রণ ছিল গৌরবের হাতে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ময়লা সংগ্রহ বাবদ চাঁদা তোলা এবং কাপ্তানবাজারের মুরগিপট্টি থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে গৌরবের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, নবাবপুর মোড় থেকে হোটেল সুপারস্টার পর্যন্ত অবৈধভাবে মুরগির পাইকারি দোকান বসাতেন গৌরব। প্রতি রাতে তাঁর অন্তত ৭০ জন অনুসারী মুরগিবাহী শত শত গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করত। মুরগি বিক্রেতার কাছ থেকে গাড়িপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং ক্রেতার কাছ থেকে গাড়িপ্রতি হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হতো। এভাবে প্রতি রাতে চাঁদা উঠত কয়েক লাখ টাকা। এই চাঁদার টাকা তুলতেন মো. রাসেল নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে গৌরবের চাচাতো ভাই পরিচয় দিতেন।
এদিকে গুলিস্তান, ওয়ারী, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবহনে চাঁদার ভাগ পেতেন গৌরব। মেডি নামের এক ব্যক্তি তাঁর এই চাঁদাবাজির বিষয়টি দেখভাল করতেন। অন্যদিকে পুরান ঢাকার বিবিরবাগিচা এলাকার আতঙ্ক জুয়েল বাহিনীসহ তিনটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ছিল গৌরবের বিরুদ্ধে। এমনকি গৌরবের নির্দেশে রাস্তা হিসেবে রেকর্ড হওয়া জমিও দুর্নীতির মাধ্যমে দোকানের জন্য বরাদ্দ দেয় ডিএসসিসি। এ ব্যাপারে ডিএসসিসির সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমান, সাবেক সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ দিদারুল আলম, গৌরবসহ ৪৮ জনের নামে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আবু আহমেদ মন্নাফী ও আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব লুকিয়ে থাকায় তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সমকাল। তাদের মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়া হলেও সাড়া দেননি তারা।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com