২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলার বিচার প্রক্রিয়া অবৈধ
বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়কে অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৪৯ আসামিই মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।
গতকাল রোববারের রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, এ মামলায় দোষীদের দুর্বল ও শোনা সাক্ষীর ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন বিচারিক আদালত। সাক্ষীরা ঘটনার বর্ণনা দিলেও কে গ্রেনেড ছুড়েছেন, তা বলেননি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর পুনঃতদন্তে তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে ২০১১ সালের জুলাইয়ে যে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়, সেটিকেও অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপি ও আসামির আইনজীবীরা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে বলেছেন, ‘সত্যের সৌন্দর্য হলো, অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের ওপর তা অনিবার্যভাবে জয়লাভ করে। তা আমাদের এই বিশ্বাস দেয়, অবশেষে ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা বিজয়ী হয়।’
তবে আওয়ামী লীগের সময়ে যারা ২১ আগস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন, তাদের প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। রায়ের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ।
যে কারণে অবৈধ
বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ঘোষণা করায় ২৪ জনকে হত্যার বিচারের ভবিষ্যৎ কী, তা অস্পষ্ট। মামলাটি পুনঃতদন্ত এবং বিচার হবে কিনা, তা হাইকোর্টে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর জানা যাবে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। কেউ কেউ বলছেন, বিচার ছাড়াই মামলাটির অবসান ঘটেছে। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ের কারণ দেখে ও নির্দেশনা নিয়ে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মামলার প্রধান আসামি মুফতি হান্নানকে ৩৪৭ দিন রিমান্ডে রেখে ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল ছয় পৃষ্ঠার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। এতেই প্রথমবারের মতো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমানের নাম আসে। তিন মাস পর ৩ জুলাই অভিযোগপত্রে তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ বিএনপি নেতা এবং ২০০৪ সালের আগস্টে দায়িত্বে থাকা পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছিল।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান জীবদ্দশায় এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অস্বীকার করে তা বিচার প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে বিচারিক আদালতে দুটি আবেদন করলেও তা খারিজ করা হয়। পরে ২০১৩ সালে উভয় আবেদনের বিপরীতে হাইকোর্টে রিভিশন দায়ের করেন। ওই বছরের ২২ এপ্রিল আবেদন উপস্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ হয়।
২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল অন্য মামলায় মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তিনি জীবদ্দশায় আদালতে তারেক রহমানসহ সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি করা ৩০ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেননি। মুফতি হান্নানের জবানবন্দি গ্রহণকারী বিচারক এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হন।
বিচারিক আদালতে ২১ আগস্ট মামলায় দণ্ডিত আসামিদের আপিল এবং ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনে হাইকোর্ট শোনা সাক্ষ্য গ্রহণ করেননি। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ মুফতি হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে তৈরি করা অভিযোগপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগের তিন শতাধিক নেতাকর্মী আহতের ঘটনায় সে সময়েই হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার বিচারিক আদালত লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃতুদণ্ড এবং তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের ১৪ জন ছিলেন হুজি সদস্য।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাইকোর্টে নতুন করে এ দুই মামলার শুনানি শুরু হয়। রায় ঘোষণার সময়ে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও শিশির মনির। উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল প্রমুখ।
হাইকোর্টের পর্যবক্ষেণ ও খালাসের কারণ
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মুফতি হান্নানের জবানবন্দির আলোকে যে দ্বিতীয় অভিযোগপত্র নেওয়া হয়েছে, সেটি ছিল অতি মাত্রায় বেআইনি। এ ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ করা হয়নি। প্রথম অভিযোগপত্রটিও গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ ওই অভিযোগপত্রটিও মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে তৈরি। যা তিনি পরে প্রত্যাহার করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া ২৫ সাক্ষীর কেউই বলেননি, কে গ্রেনেড ছুড়েছে বা কাউকে ছুড়তে দেখেছেন। ফলে প্রকৃত খুনি কে, এর প্রমাণ নেই। শুধু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অন্য আসামিকে সাজা দেওয়া যায় না।
রায়ের পর আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বিচারটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত বলেছেন, এক সাক্ষীর সঙ্গে আরেক সাক্ষীর মিল নেই। শোনা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়া হয়েছিল। সে জন্য তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সবাইকে আদালত খালাস দিয়েছেন।
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ স্বচক্ষে ঘটনা দেখেছেন– এমন প্রমাণ নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর নির্যাতন করে নেওয়া হয়েছে। মুফতি হান্নানই দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় জবানবন্দিটি পরে তিনি প্রত্যাহার করেন। তাই এর আইনি ভিত্তি নেই।
রায়কে স্বাগত জানিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলা প্রমাণিত হয়নি। দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে যাদের আসামি করা হয়েছে, তা আইনিভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ঘটনাস্থলে কে গ্রেনেড ছুড়েছে, তা সাক্ষ্য বা স্বীকারোক্তিতে নেই।
জয়নুল আবেদীন বলেন, অভিযোগপত্রে তারেক রহমানের নাম ছিল না। তাঁকে সাজা দিতে পরে আব্দুল কাহার আকন্দকে (সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা) দিয়ে এ মামলায় জড়ানো হয়। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় তারেক রহমানকে সাজা দিয়ে চিরজীবন দেশের বাইরে রাখতে চেয়েছিল। সরাসরি সাক্ষ্য না থাকলে কাউকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দেওয়া যায় না।
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, শেখ হাসিনা ২০০৪ সালে ১৬১ ধারা জবানবন্দি দেন, সেখানেও তারেক রহমানের নাম ছিল না। ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তারেক রহমানকে মামলায় জড়ান।
ফিরে দেখা
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২১ আগস্ট মামলার জন্য পুলিশ জজ মিয়া নামে নোয়াখালীর এক তরুণকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁর কাছ থেকে হামলায় দায় স্বীকার করে ‘জবানবন্দি’ আদায় করে। যা ‘জজ মিয়া নাটক’ নামে খ্যাত।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন করে তদন্ত শুরু করে। ২০০৮ সালের ১১ জুন জজ মিয়াসহ ১৭ জনকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন অভিযোগপত্রে হুজি নেতা মুফতি হান্নান, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যায় বিদেশি জঙ্গিদের সহযোগিতায় ২১ আগস্ট হামলা করে হুজি। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ইন্ধন ছিল এতে। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আসে পাকিস্তান থেকে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ২০০৯ সালের ২২ জুন অধিকতর তদন্তের আগের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। দুই বছর পর তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। আসামির সংখ্যা হয় ৫২। তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় অন্য মামলায়।
দণ্ডিত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টু ছাড়াও এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরীকে এক মামলায় দুই বছর এবং অপর মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্ব রয়েছেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইর মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপকমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খানেরও সাজা হয়েছিল।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com