ঢাকা, ২১ নভেম্বর, ২০২৪
Banglar Alo

বাসযোগ্য পৃথিবী, বাসযোগ্য দেশ চাই

Publish : 08:28 AM, 21 September 2024.
বাসযোগ্য পৃথিবী, বাসযোগ্য দেশ চাই

বাসযোগ্য পৃথিবী, বাসযোগ্য দেশ চাই

সোহেলী চৌধুরী :

অজানা মহাবিশ্বে কোটি কোটি ছায়াপথ আছে। আমরা মিল্কি ওয়ে ছায়াপথের বাসিন্দা। মিল্কি ওয়ের আছে কোটি কোটি গ্রহ। কিন্তু তার মধ্যে পৃথিবী নামের গ্রহ আছে মাত্র একটি; যা জীবের একমাত্র আবাসস্থল বলে ধরা হয়। এই পৃথিবীই ক্রমশ বিরূপ হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের এই গ্রহটির বর্তমানে বড় ধরনের সমস্যা তিনটি। জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও দূষণ। আর এই তিনটি সমস্যার মূল কারণ আমরাই। আধুনিকতার পরশে বেশি সুখের আশায় আমরা এই গ্রহটির প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। শ্যামল নিসর্গের বদলে এই পৃথিবীতে আমরা গড়ে তুলেছি ইট, কংক্রিট আর ইস্পাতের ধূসর জঙ্গল। ফলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। পৃথিবীর নানা জায়গায় মুহুর্মুহু প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, তীব্র জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা, প্রচণ্ড খরা, ঘন ঘন বজ্রপাত, উপর্যুপরি ভয়াবহ দাবানল, হিমবাহের অস্বাভাবিক বিগলন, সমুদ্র পানির অম্লত্ব ও উচ্চতা বৃদ্ধি, বৃষ্টিচক্রে পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া, মহামারি, অকালমৃত্যু ইত্যাদি দুর্ঘটনা আমাদের খুব সহজেই বলে দিচ্ছে মানবজাতি এক গভীর অস্তিত্ব সঙ্কটের সম্মুখীন।

চীনের উহান থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারি থেকে পুরোপুরি উত্তরণের আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীতে খাদ্য সঙ্কট তৈরি করেছে। সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় এ যুদ্ধ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা তৈরি করেছে নতুনভাবে।  জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও দূষণ সঙ্কটের সঙ্গে যুদ্ধ যোগ হয়ে বৈশ্বিক পরিবেশ এখন চরম এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন।

এর মাঝেই লোহিত সাগরের সিনাই উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে মিসরের পর্যটন-নগরী শার্ম আল-শেখে ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৭) শেষ হয়েছে। অবশ্য চূড়ান্ত প্রাপ্তি শুধু আশ^াসেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বিশ্বের একশ ৯৬টি দেশের অন্তত ৫০ হাজার প্রতিনিধি জলবায়ু সঙ্কট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ৬ নভেম্বর থেকে জড়ো হন শার্ম আল-শেখে। এই সম্মেলন বিশ্বকে জলবায়ু সঙ্কট উত্তরণে আশার বাণী শোনাতে এবারো যথারীতি ব্যর্থ হয়েছেন বিশ্বনেতারা।

২০১৫ সালে হওয়া প্যারিস চুক্তিতে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে কিংবা বড়জোর দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু অনেক দেশ এটি মানেনি। ফলে এই শতাব্দীতেই তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অতিক্রম করবে এবং তার ফলে উপরে বর্ণিত নানা ধরনের দুর্যোগ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ৩০ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে বিষয়টি ততই কঠিন হয়ে পড়ছে।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার জন্য ছয়টি ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বনের কথা বলছে। বলা হচ্ছে, এই কৌশলের মাধ্যমে বছরে ৪৫ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করা সম্ভব। এই ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- শক্তি (১২ দশমিক পাঁচ গিগাটন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ও শক্তির অপচয় বন্ধ), শিল্প-কলকারখানা (সাত দশমিক তিন গিগাটন নিষ্ক্রিয় বা নবায়নযোগ্য শক্তিভিত্তিক গরম ও ঠাণ্ডা পদ্ধতি, শক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি, গ্যাস লিকেজ বন্ধ করা), কৃষি ও খাদ্য (আট দশমিক সাত গিগাটন পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা, সুস্থায়ী খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য অপচয় বন্ধ করা), প্রকৃতিভিত্তিক কৌশল (পাঁচ দশমিক নয় গিগাটন বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করা, বাস্তুতন্ত্র অবনয়ন রুখে দেওয়া ও পুনরুদ্ধার করা), পরিবহন (চার দশমিক সাত গিগাটন বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে গণপরিবহন, হাঁটা ও সাইকেল ব্যবহার), ভবন ও শহর (পাঁচ দশমিক নয় গিগাটন সবুজ স্থাপত্য, শক্তি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা, পানি পুনর্ব্যবহার ইত্যাদি)।

পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তি হার আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার’ জীববৈচিত্র্যের বর্তমান বিলুপ্তির হার অতীতের তুলনায় বেশি বলে উল্লেখ করেছে (জানুয়ারি ২০২২)। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, আবাসস্থল ধ্বংস, অতি আহরণ, পরক (ইনভেসিভ) প্রজাতির আক্রমণ ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিগত কয়েক দশকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে অনেক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হলেও সেসবের দ্বারা কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যায়নি।

প্রতিটি দেশের সরকারকে জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল রক্ষায় সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা এবং তা কঠোরভাবে কার্যকর করা, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রম মেনে চলা, জীববৈচিত্র্যের প্রজাতি ও সংখ্যার ওপর মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ তথা গবেষণার জন্য পৃথক জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করাসহ জীববৈচিত্র্যবান্ধব প্রজন্ম সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ব্যক্তি পর্যায়ে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, দূষণ ঘটানোর প্রবণতা পরিত্যাগ, জীববৈচিত্র্য অতি আহরণের মানসিকতা এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংসের প্রবণতা বর্জনসহ জীববৈচিত্র্যকে যান্ত্রিক মূল্যে বিচার না করার চেতনা সৃষ্টি করা দরকার।

সভ্যতার আরেক অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে দূষণ। জল, স্থল আর বাতাস ক্রমাগত দূষিত হয়ে পড়ছে। ১৭ মে বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ‘ল্যানসেট প্লানেট হেলথ’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিশ্বে দূষণজনিত কারণে বছরে ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। বছরে সব থেকে বেশি মৃত্যু (৬৫ থেকে ৭০ লাখ) হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি বলছে, প্লাস্টিক দূষণের কারণে আমাদের এই পৃথিবীর দম বন্ধ হয়ে আসছে। একবার ব্যবহারোপযোগী প্লাস্টিক দ্রব্যগুলো ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ার পরও সেগুলোর ব্যবহারে আমরা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে বছরে পাঁচ লাখ কোটি। বছরে প্রায় ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে বছরে প্রায় একশ ১০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হবে। এই মুহূর্তে সমুদ্রে প্রায় ২০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। মানুষ তথা জীবজগতের জন্য প্লাস্টিক কণা, বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিকস ও ন্যানোপ্লাস্টিকস নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। প্লাস্টিকে ব্যবহৃত রাসায়নিক আমাদের শরীরের হরমোনক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়েই তৈরি হয় প্লাস্টিক। নেচার গ্রুপের জার্নাল ‘নেচার সাসটেইনেবিলিটি’র মতে, প্লাস্টিক শুধু বর্জ্য হিসেবে সমস্যা তৈরি করছে না, তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় চার দশমিক পাঁচ শতাংশ বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাসও তৈরি হচ্ছে।

সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির কার্যনির্বাহী পরিচালক ইংগার আন্ডারসন সবাইকে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একত্র হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একবার ব্যবহারোপযোগী প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা, যত বেশি সম্ভব প্লাস্টিক রিসাইকল করা, শপিংব্যাগ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা এবং পাতলা শপিংব্যাগ উৎপাদন বন্ধ করা, প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলা এবং ভাগাড়ে যাওয়ার আগেই তা পৃথক করার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে প্লাস্টিকদূষণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বৈশ্বিক শঙ্কা বা দুর্যোগের খবর রেখে এবার আসা যাক আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের কথায়। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম; পরিবেশ দূষণে দ্বিতীয়।

এমন পরিস্থিতিতে খুব সহজেই বলা চলে, দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক ঝুঁকিতে আছে। এই ঝুঁকি বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে অবাধে বৃক্ষনিধন। নানা গবেষণা বলছে, একটি দেশে বনভূমি থাকা প্রয়োজন ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশে আছে মাত্র ১৭ শতাংশ।

অবশ্য শুধু বৃক্ষরোপণ করলেই আর অবাধে গাছ না কাটলেই পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ বৃক্ষেও সঠিকভাবে বাঁচার জন্য সহায়ক ও উপযোগী পরিবেশ থাকতে হবে। সেই পরিবেশ কোনোভাবেই নিশ্চিত হচ্ছে না। বায়ু দূষণের মাধ্যমে বৃক্ষের স্বাভাবিক জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, ক্লোরিন ইত্যাদি বায়ু দূষণকারী উপাদান বৃক্ষের স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সালফার অক্সাইড, হাইড্রোজেন ফ্লুরাইডের প্রভাবে বৃক্ষের স্বাভাবিক সালোকসংশ্লেষন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে অক্সিজেন কমে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পৃথিবীর সকল প্রাণীকূলের ওপর পড়ছে।

বাংলদেশের বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর এই বায়ুদূষকের উপস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে। বায়ুর খারাপ মানের জন্য জনস্বাস্থ্যও বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সুইজারল্যান্ডের দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মতো এবারো প্রথম এবং ঢাকা রাজধানী শহরগুলির মধ্যে দ্বিতীয়। যেখানে ডাব্লিউএইচও-র বায়ুমান নির্দেশক গাইডলাইন অনুসারে পিএম দুই দশমিক পাঁচ নামে পরিচিত ছোট ও বিপজ্জনক বায়ু বাহিত কণার গড় বার্ষিক ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। সেখানে বাংলাদেশে এর পরিমাণ ৭৬ দশমিক নয় মাইক্রোগ্রাম।

বায়ু দূষণের অসংখ্য কারণ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো, ইটভাটা, রাস্তাঘাট ও বাড়ি নির্মাণের ফলে সৃষ্ট ধুলোবালি, যানবহনের দূষণ। মোট কথা বাংলাদেশে বায়ু দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে।

দেশে পরিবেশের যে বিপর্যয় এর অন্যতম আরো একটি কারণ শব্দ দূষণ। শব্দ যখন ক্ষতিকর এবং বিরক্তির কারণ হয় তখনই তাকে বলা হয় শব্দ দূষণ। আমরা ২০ ডেসিবেল থেকে একশ ২০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ শুনতে পাই। ২০ ডেসিবেলের নিচে এবং একশ ২০ ডেসিবেলের উপরে আমরা শব্দ শুনতে পাই না। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণমাত্রা ৬০-৭০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ। অর্থাৎ ৭৫ ডেসিবেলের উচ্চমাত্রার শব্দই শব্দ দূষণ।

এই শব্দ দূষণ শুধু মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে না, অন্য সকল পশুপাখি, গাছপালা সবার জন্য ক্ষতি করছে। শব্দ দূষণের কারণে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। আধুনিকতা আর উন্নয়নের নামে শব্দ দূষণ বন্ধ করা প্রয়োজন। যানবাহনের অতিরিক্ত হর্নের ব্যবহার, কলকারখানার উচ্চ শব্দ, উচ্চ শব্দযুক্ত গান-বাজনা বন্ধ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া পানি দূষণ, নদ-নদী সংরক্ষণ করতে না পারা, মাটির দূষণের ফলে আমাদের ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ছে।

বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০২১), জাতীয় পরিবেশ নীতি (২০১৮), বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন (২০১৭), পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০১৬), পরিবেশ আদালত আইন (২০১০), শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা (২০০৬) রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এমনসব আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। ফলে যা হওয়ার হচ্ছে। এতসব আইন-বিধি আর নীতিমালা কোনোভাবেই পরিবেশ বিপর্যয়কে রোধ করতে পারছে না।

সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে দুই লাখের বেশি। দূষণে মৃত্যুর হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।

চেঞ্জ ইনিসিয়েটিভের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতায় বাংলাদেশে প্রতিবছর খরচ হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এই দূষণে প্রতি পরিবারের বছরে গড়ে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয় ১০ হাজার পাঁচশ ৮৭ কোটি টাকা।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, গত ২৫ বছরে ৬৫ হাজার হেক্টর বনভূমি উজার হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ৩০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি কমেছে। ঢাকার এক-চতুর্থাংশ শিশুর ফুসফুসের সক্ষমতা কমেছে। বিশ্ব ব্যংকের সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় সীসা দূষণের শিকার ছয় লাখ মানুষ। এক কোটি ২৭ লাখ মানুষের শরীরে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটেছে।

‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) ২০২২’ প্রতিবেদনে আরো ভয়ের কথা জানায়। এ প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশ রক্ষা সূচকে বিশ্বের একশ ৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একশ ৭৭। ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক ডব্লিউইএফের সহায়তায় গবেষণাটি করেছে।

গবেষণার ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন দেশের অবস্থান তুলে ধরতে বৈশ্বিক এ সূচক প্রকাশ করা হয়। এর আগে ২০২০ ও ২০১৮ সালের তালিকায় বাংলাদেশ একশ ৮০ দেশের মধ্যে ছিল একশ ৭৯তম। ২০১৬ সালের তালিকায় একশ ৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল একশ ৭৩। আর ২০১৪ সালের তালিকায় একশ ৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল একশ ৬৯।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ও ভারত তালিকার নিচের দিকে অবস্থান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বায়ুর মান উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনায় এ দুটি দেশ পিছিয়ে আছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ রক্ষায় আইন ও প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই, কিন্তু আইনের প্রয়োগে বড় দুর্বলতা রয়েছে। শুধু সরকার নয়, ব্যক্তি পর্যায়েও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

মোট ১০টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ইপিআই সূচক তৈরি করা হয়। এগুলো হলো বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ এবং কৃষি। ১০টি বিষয়ের প্রতিটিতে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে বিভিন্ন দেশের অবস্থানের ক্রমতালিকা বা ইপিআই র‌্যাঙ্কিং তৈরি করা হয়। এবারের তালিকায় বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ২৩ দশমিক ১০।

বাংলাদেশে পরিবেশ সঙ্কট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি একাধিক প্রতিবেদনে দেশের পরিবেশ সঙ্কটের হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও দেশে তার অভিঘাত গুরুতর হয়ে উঠছে। দেশের জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য প্রাচুর্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বায়ুদূষণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান উপরে। দেশের পানি ও মাটিও ভালো নেই। প্লাস্টিকদূষণও বেড়ে যাচ্ছে। প্রবল জনসংখ্যার চাপে দেশের পরিবেশকে ভারসাম্যময় অবস্থায় রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশ সংশ্লিষ্ট নীতিমালা ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনাকে নিবিড় গবেষণার আলোকে আরো উন্নত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা।

আধুনিকতা আমাদেরকে এক দুষ্টুচক্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হয় আমাদের জীবন, আগামী প্রজন্ম কাউকেই রক্ষা করতে পারবো না পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে। একটি সুস্থ পরিবেশ পাওয়া আমার সাংবিধানিক অধিকার। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ, দূষণ হ্রাসকরণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও যুদ্ধ বন্ধ করা প্রয়োজন।


সোহেলী চৌধুরী : সাংবাদিক ও সাবেক জনকল্যাণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন।

Banglar Alo

সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড

৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০

নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]

©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com

Develop by _ DigitalSolutions.Ltd
শিরোনাম ১৫ বছর পর সেনাকুঞ্জে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া শিরোনাম নতুন সিইসি নাসির উদ্দীন, চার কমিশনার হলেন যারা শিরোনাম শাকিবকে জড়িয়ে ধরে ‘ইমোশনাল’ হলেন পরীমণি শিরোনাম জামায়াতের নিবন্ধনের আপিল শুনানি হতে পারে ২৬ নভেম্বর শিরোনাম দায়িত্ব বুঝে নিলেন নতুন আইজিপি বাহারুল আলম শিরোনাম শেখ হাসিনা এখনও প্রধানমন্ত্রী— এমন কথা বলেননি ট্রাম্প