সুদহার আবার বাড়াতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার হিসেবে বিবেচিত রেপো সুদ আরেক দফা বাড়তে পারে। এই অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতিতে এ ঘোষণা থাকতে পারে। রেপো বা পুনঃক্রয় চুক্তির (ট্রেজারি বিল জমা রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার) সুদহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হতে পারে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদ আরও বেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। এমন এক সময় এ আলোচনা সামনে এসেছে, যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও শতাধিক পণ্য-সেবায় ভ্যাট ও অন্য কর বাড়িয়েছে সরকার। এ পরিস্থিতিতেও সরকারি চাকুরের ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে নীতি সুদহার বাড়লেও সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের জন্য ঋণের সুদহার ৪ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ডলার সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে এখন বেসরকারি বিনিয়োগ তলানিতে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গত নভেম্বরে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমেছে। অথচ মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে গত ডিসেম্বর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশে উঠেছে। যদিও এই অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। আড়াই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো ও সরকারি চাকরিজীবীর মহার্ঘ ভাতার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।
বিশ্বের অন্য দেশ বেশ আগেই সুদহার বাড়ালেও ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সীমা আরোপ করা হয় ৯ শতাংশ। আবার বিশ্বের অন্য দেশ যখন সুদহার কমাতে শুরু করে, তখন বাংলাদেশে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সুদহার নির্ধারণে প্রথমে ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু হয়। পরে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। অল্পদিনের ব্যবধানে সুদহার দ্রুত বেড়ে এখন ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটা সুফল পাওয়া যায়নি, যাবেও না। বাজার তদারকি বাড়ানোর মাধ্যমে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভাঙার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, দেশের প্রধান সমস্যা হলো, ব্যাংক থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা লুট হয়ে বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এখানে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব বেশি করার নেই। এসব অর্থ ফেরত আনা অনেক কঠিন।
জানা গেছে, এই অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার বিষয়ে গতকাল রোববার থেকে আলোচনা শুরু করেছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এটা হবে বর্তমান গভর্নরের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা। মুদ্রানীতি ঘোষণার আগে প্রথা অনুযায়ী গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন গভর্নর। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি না কমলে নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হবে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নর বলেন, বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি শুধু মুদ্রা সরবরাহজনিত কারণে হচ্ছে, তেমন নয়। এরই মধ্যে কয়েক দফা সুদহার বাড়ালেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি।
রেপোর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ধার দিয়ে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। এর পাশাপাশি ব্যাংক রেটও একধরনের নীতি সুদহার। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জুডিশিয়ারি সার্ভিস, বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ব্যাংক রেটে ঋণ পেয়ে থাকেন। ফলে ব্যাংক রেট বাড়লে বা কমলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীর ঋণের খরচ বাড়ে বা কমে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর অনেক ধরনের পুনঃঅর্থায়নের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাংক রেট যুক্ত করা আছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে চালু হওয়া পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কত শতাংশ সুদে অর্থায়ন নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ কত শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া যাবে তা বলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর পুনঃঅর্থায়ন নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন আর ব্যাংক রেটের তেমন কার্যকরিতা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাংক রেট ছিল ৫ শতাংশ। তবে সব ধরনের সুদহার কমানোর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের জুলাইয়ে এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংক রেট কমিয়ে ৪ শতাংশে নামানো হয়। ওই বছরের ৩০ জুলাই রেপোর সুদহার কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়। রিভার্স রেপো তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকগুলো টাকা রাখলে সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৪ শতাংশ। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে একই দিন আরেক সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাংক রেট ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ শতাংশে নামানো হয়।
করোনা-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় ২০২২ সালের ৩০ মে প্রথমে রেপোর সুদহার বাড়ানো হয়। রোপোর সুদহার ওই সময়ের ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে টানা ১৩ দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ গত অক্টোবরে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আর স্পেশাল রেপোর সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশ থেকে এখন সাড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে। অথচ ব্যাংক রেট সেই ৪ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
বেসরকারি এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের বিপরীতে সরকারই এখন ১২ শতাংশ বা তার বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। ব্যাংকগুলো ১০ থেকে ১১ শতাংশ বা তার বেশি সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। আন্তঃব্যাংক কলমানিতে এক রাতের ধার নিতে গুনতে হচ্ছে ১০ শতাংশের ওপরে। অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দিতে ব্যাংক রেট ৪ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলো লোকসান করেই নিজ কর্মীদের ঋণ দিচ্ছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com