রমরমা হার্টের চিকিৎসা পণ্যের অবৈধ কারবার
হাত বাড়ালেই মিলছে হার্টের নিম্নমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম। ভারত থেকে চোরাই পথে এসব পণ্য আনছে একটি চক্র। দাম কমের কারণে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালও দেদার ব্যবহার করছে। এতে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, সরকারও হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব। খোদ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তদন্তে হার্টের চিকিৎসা সরঞ্জামের চোরাই কারবারে ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে। এর পরই নড়েচড়ে বসে সংস্থাটি।
সমকালের অনুসন্ধানেও নিম্নমানের সরঞ্জাম চোরাচালান চক্রের দু’জনের সম্পৃক্ততা মিলেছে। তারা হলেন– ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চিফ টেকনিশিয়ান মোরশেদ উদ্দিন ও স্পন্দন লিমিটেড কোম্পানির কর্মচারী মাসুদুর রহমান। মোরশেদ আত্মীয়স্বজনের নামে কথিত কোম্পানি খুলে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আর মাসুদ অবৈধ পথে সরঞ্জাম এনে বিক্রি করেন। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক তাঁর প্রভাব বেশি।
জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ড. আকতার হোসেন সমকালকে বলেন, হার্টের চিকিৎসার সরঞ্জামের অবৈধ কারবার নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। আজ ১৩ জানুয়ারি বৈঠকের জন্য ব্যবসায়ীদের ডাকা হয়েছে। সেখানে এই বিষয়টি ছাড়াও এ খাতের সরঞ্জামের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে বিশদ আলোচনা করা হবে। আশা করছি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবৈধ কারবারিদের আমরা রুখতে পারব।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের বেসরকারি ২৭ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৪ ধরনের স্টেন্ট, হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেলুন, গাইডওয়্যার, ক্যাথেটার, ভাল্ভ, অক্সিজেনেটরসহ নানা সরঞ্জাম আমদানি করে। ঔষধ প্রশাসনের নিবন্ধন ছাড়া এসব চিকিৎসা উপকরণ আমদানির কোনো সুযোগ নেই। এমনকি অন্যের নিবন্ধিত কোম্পানির মাধ্যমে সরবরাহের ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। কিন্তু অসাধু চক্র নিবন্ধন ছাড়াই দেদার ব্যবসা করছে।
সাধারণত ডিলারশিপ ছাড়া কোনো দেশ থেকে হৃদরোগ চিকিৎসার স্টেন্ট ও সরঞ্জাম আমদানি করা যায় না। ভারতের কিছু হাসপাতাল স্বল্প মেয়াদের সরঞ্জাম কম দামে বিক্রি করে। অসাধু চক্রটি প্রতিনিধির মাধ্যমে এসব কিনে নৌপথ ও কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশে আনছে। ভ্যাট-ট্যাক্স এড়ানোয় লাভ বেশি হচ্ছে। ক্রমেই বাড়ছে নিম্নমানের হার্টের চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, তদন্তে তারা চোরাই পথে নিম্নমানের হৃদরোগ চিকিৎসার সরঞ্জাম আনার কারবারে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। তাদের প্রথমে নোটিশ দিয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, চক্রের বাইরেও দ্রুত চিকিৎসার জন্য অনেক রোগীর স্বজন অবৈধভাবে সরঞ্জাম আনছেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। কারণ এসব সরঞ্জাম একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে আনতে হয়। অবৈধভাবে আসার কারণে তা রক্ষা হচ্ছে না। ফলে রোগীরা ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশে প্রয়োজনীয় মেডিকেল ডিভাইসের ৯৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর। নীতিমালা অনুযায়ী ঔষধ প্রশাসনের নিবন্ধন ও নির্ধারিত মূল্যের বাইরে গিয়ে কোনো ডিভাইস বাজারজাতের সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, গত বছর
হৃদরোগ চিকিৎসা উপকরণ নিয়ে অবৈধ কারবারের কিছু তথ্য-প্রমাণ ঔষধ প্রশাসনকে দিলে ব্যবস্থা নেয়। তবে এখন আবার কয়েকটি চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
হার্ট ফাউন্ডেশনে মোরশেদই সর্বেসর্বা
একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চিফ টেকনিশিয়ান মোরশেদ উদ্দিনকে আর্থিক সুবিধা না দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে হৃদরোগ চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহ করার সুযোগ নেই। কোম্পানিকে তিনি ব্যবসায়িক শেয়ার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। রাজি না হলে তাকে সরঞ্জাম সরবরাহের অনুমোদন আটকে দেন মোরশেদ।
জানা যায়, হার্ট ফাউন্ডেশনে চাকরির কারণে মোরশেদ নিজের নামে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেননি। আত্মীয় ফয়সাল হোসাইনের নামে জিএইচসি ট্রেডিং করপোরেশন খুলে হার্ট ফাউন্ডেশনে অধিকাংশ হৃদরোগ চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহ করছেন। ঔষধ প্রশাসনের নিবন্ধন ছাড়াই তারা চড়া মূল্যে কারবার চালাচ্ছেন। অবশ্য প্রাণ কোম্পানির নামে জিএইচসি ট্রেডিং করপোরেশনের ডিলারশিপ রয়েছে।
ইউনিক লাইফ সায়েন্স কোম্পানিতে শেয়ার রয়েছে মোরশেদের। নাজমুল হুদার মালিকানাধীন কোম্পানিটি পরিচালনা করছেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ও জুনায়েদ আলী। হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রভাব খাটিয়ে মোরশেদ এসব প্রতিষ্ঠানে শেয়ার নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অবৈধভাবে চিকিৎসা উপকরণ আনার অভিযোগ রয়েছে।
হৃদরোগ চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গ্রিন হার্ট। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আসলাম উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘মোরশেদ উদ্দিনকে আর্থিক সুবিধা না দিয়ে হার্ট ফাউন্ডেশনে সরঞ্জাম সরবরাহের সুযোগ কারও নেই। এ জন্য অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় এখানে হার্টের চিকিৎসার সরঞ্জামের দাম বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একবার হার্ট ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ সব ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে আমি বলেছিলাম, হার্ট ফাউন্ডেশনে পণ্য সরবরাহ করতে হলে মোরশেদ উদ্দিনকে উচ্চ কমিশন দিতে হয়। ফলে সরঞ্জামের দাম বাড়ে। মোরশেদকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সব নথিও দিয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, উল্টো সেখানে আমার ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
অভিযোগের বিষয়ে মোরশেদ উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘হার্টের চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবসায় ৫০টির বেশি কোম্পানি জড়িত। আমার একার পক্ষে সবাইকে খুশি করা সম্ভব নয়।’ আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করলেও গ্রিন হার্টের নথির বিষয় জানালে তিনি বলেন, ‘সেখানে আমার ব্যবসায়িক শেয়ার ছিল। ব্যাংকের
মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে। এটিকে কমিশন বাণিজ্য বলা ঠিক হবে না।’ আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি মোরশেদ।
চট্টগ্রামে মাসুদের রামরাজত্ব
দীর্ঘদিন অবৈধভাবে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে হার্টের চিকিৎসার সরঞ্জাম ব্যবসায় রামরাজত্ব করছেন স্পন্দনের কর্মচারী মাসুদুর রহমান। প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকান হার্টের রিং সরবরাহ করে। তবে ডিলারশিপ ও ঔষধ প্রশাসনের নিবন্ধন ছাড়াই মাসুদ একাধিক কোম্পানির সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছেন। মূলত অবৈধভাবে আসা হার্টের নিম্নমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম রাজধানীতে কম চলে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এগুলো মাসুদ চট্টগ্রামে বাজারজাত করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের এক চিকিৎসক সমকালকে বলেন, মাসুদের সঙ্গে বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। মাসে মাসে কমিশন দেওয়া হয়। বেশি কমিশন পাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাসুদের সরবরাহ করা সরঞ্জাম বেশি ব্যবহার করে।
অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি মাসুদুর রহমান। উল্টো প্রতিবেদককে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘নিউজ করলে আপনার খরব আছে। সাহস থাকলে নিউজ করেন।’ পরে স্পন্দন লিমিডেটের মালিক আনিসুর রহমানকে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com