লজিং মাস্টার থেকে শতকোটিপতি
ছাত্রজীবনে তিনি মানুষের বাড়িতে জায়গির বা লজিং মাস্টার (থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে অবস্থাসম্পন্ন সন্তানদের পড়ালেখা শেখানো) হিসেবে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। পৈতৃক সহায়-সম্বল বলতে ছিল না তেমন কিছুই। এক সময়ের লজিং মাস্টার আওয়ামী লীগ নেতা সেই আবদুর রহমানই এখন শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক।
ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা) আসন থেকে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এ সদস্য। পরবর্তী দুটি নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে সংসদ সদস্য (এমপি) হন। দায়িত্ব পালন করেছেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরও। আর প্রথমবার এমপি হওয়ার পর থেকেই আবদুর রহমানের সম্পদের তালিকায় যুক্ত হতে থাকে নিত্যনতুন স্থাপনা ও জায়গার নাম।
অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে শুধু নিজের নামেই নয়, স্ত্রী-সন্তান এমনকি মেয়ের জামাইয়ের নামেও কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন এ আওয়ামী লীগ নেতা।
আবদুর রহমান ১৯৮৬ সালে প্রথমে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হয়ে একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বড় পদ পান। বর্তমানে তিনি দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।
প্রতাপশালী এ নেতা নিজের জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখে নিজেকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যান। আর এ কারণে ছোট-বড় সবাই তাকে ‘দাদুভাই’ বলে ডাকতেন। ক্ষমতায় থাকার কারণে ভুক্তভোগী অনেকেই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না।
এলাকায় তাকে নিয়ে জনশ্রুতি ছিল যে, টাকা ছাড়া আবদুর রহমান একপাও চলেন না। আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও শোনা যায়, তিনি ৫ আগস্টের পরপরই দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় আবদুর রহমান তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ২৮ লাখ ১১ হাজার ৬২৪ টাকা। আর নিজের নামে ফরিদপুরের মধুখালীর কামালদিয়ায় একটি বাড়ি থাকার কথা উল্লেখ করলেও স্ত্রীর নামে ঢাকায় চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন।
আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে তার নিজ এলাকায় রয়েছে অজস্র অভিযোগ। জায়গা দখল, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি, মনোনয়ন-বাণিজ্য, চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া এবং নিজের সংসদীয় এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নকাজ থেকে পার্সেন্টেজ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বাগিয়ে নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
দেশে অঢেল সম্পদ থাকার পাশাপাশি বিদেশেও তার বাড়ি রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। কথার জাদুকর হিসেবে পরিচিত এ নেতাকে নিয়ে ফরিদপুর জুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা ছিল সবসময়ই।
ফরিদপুর-১ সংসদীয় আসনের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধুখালীর কামালদিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া আবদুর রহমান কলেজ জীবনের শুরুতে ফরিদপুর শহরে অন্যের বাড়িতে ‘লজিং মাস্টার’ হিসেবে থেকে পড়াশোনা করতেন।
স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, আবদুর রহমানের বাবা মারা যাওয়ার সময় মাত্র ১৪ শতাংশ জমি রেখে যান। সেই তিনিই আজ শত শত কোটি টাকার মালিক। এটা কীভাবে সম্ভব, সেটা বুঝে উঠতে পারেন না তারা।
আওয়ামী লীগ সরকার টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে ফরিদপুর-১ আসনের তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র ‘রাজত্ব’ কায়েম করেন আবদুর রহমান। তার বিরুদ্ধে রয়েছে দখলদারির অভিযোগ। নিজ নামে এবং ছেলেমেয়ের নামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ব্রাহ্মণকান্দায় ‘আবদুর রহমান কলেজ’ ও ‘আয়েশা-সামি’ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারি জায়গা দখল করে সেই জায়গা প্রভাব খাটিয়ে কলেজের নামে করে নেন। কাদিরদি এলাকায় সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা একটি কারিগরি কলেজের নাম তার মা ও বাবার নামে করার চেষ্টা চালান। মধুখালী, বোয়ালমারীতে নিজ নামে ছাড়াও ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর নামে প্রভাব খাটিয়ে বেশি দামের জমি কম দামে কেনার অভিযোগ রয়েছে।
সাতৈর এলাকায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে স্ত্রী মির্জা নাহিদ ইসলাম বন্যা ও মেয়ের জামাতা জুবের নিলয়ের নামে একটি স্বয়ংক্রিয় ইটভাটা (রাজ সিরামিক ব্রিকস) নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। চাপাদহ বিল এলাকায় মন্ত্রী পদের প্রভাব খাটিয়ে বিশাল জলাশয় দখল করে মৎস্য খামার করার কাজ চলমান ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সে কাজ বন্ধ রয়েছে।
নিজ সংসদীয় এলাকার তিনটি উপজেলায় আলাদা আলাদা নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলারও অভিযোগ রয়েছে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে। এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা। তাদের দিয়েই বিএনপিসহ অন্যান্য দলের স্থানীয় নেতাকর্মী এবং ব্যবসায়ীকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখতেন। হামলা করে, মামলা দিয়ে বিরোধীপক্ষের অনেক নেতাকে এলাকা ছাড়া হতে বাধ্য করেছেন বলে তথ্য রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, আবদুর রহমানের অবৈধ আয়ের ‘টাকা কালেকশনে’ তিনটি উপজেলাতেই ছিল তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তি।
তাদের মধ্যে রয়েছেন মধুখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র মোরশেদ লিমন ও একই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম বকু, বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিরধা পিকুল ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক শরীফ সেলিমুজ্জামান লিটু এবং আলফাডাঙ্গা উপজেলার সাবেক পৌর মো. সাইফার। তাদের দিয়েই আবদুর রহমান স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খাত থেকে টাকা আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে তিনটি উপজেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে।
শুধু নিজ নির্বাচনী এলাকাতেই নয়, ফরিদপুর সদর আসনেও ছিল আবদুর রহমানের একচ্ছত্র আধিপত্য। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তার কথায় চলতেন।
এ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আবদুর রহমানকে টাকা দিলেই পদ পাওয়া যেত। তিনি জেলা আওয়ামী লীগে পদ বিক্রি করেই কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন।
শুধু আওয়ামী লীগই নয়, ছাত্রলীগের অনেককে টাকার বিনিময়ে জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের পদ দিয়েছেন। নগরকান্দা উপজেলার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কাজী আবদুস সোবহানকে জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি করেছেন কোটি টাকার বিনিময়ে এমন কথা এলাকায় চাউর হয়।’
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর ও দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন জেলার সংসদ সদস্য প্রার্থীদের কাছ থেকেও আবদুর রহমান কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
আলোচিত এই আওয়ামী লীগ নেতার স্ত্রী মির্জা নাহিদ ইসলাম বন্যা ও তার শ্যালক পিন্টুর বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তারা দুজন মিলে তিনটি উপজেলায় থানার দালালি, মনোনয়ন-বাণিজ্য ও চাকরি দেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে ভাষ্য এলাকার অনেকেরই। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী হওয়ার পর আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে এই তিন উপজেলার অনেকের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া সরকারি বরাদ্দের টিআর-জিআরসহ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। একসময়ের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান আবদুর রহমানের নামে-বেনামে ঢাকার পূর্বাচল, ধানমণ্ডি, উত্তরা ও পরীবাগে বাড়ি এবং ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ফরিদপুর অঞ্চলের তৎকালীন মুজিব বাহিনীর এক নেতা বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আবদুর রহমান এলাকায়ই ছিলেন না। তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার প্রশ্নই উঠে না। সে একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ঢাকার পরিবাগে আবদুর রহমানের বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা। এরপর থেকেই আর দেখা মেলেনি একসময়ের দোর্দ-প্রতাপশালী এ নেতার। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য তার মোবাইল ফোনে কল করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com