বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার গঙ্গা চুক্তিবিষয়ক যৌথ কমিটির ৮৬তম বৈঠকের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। গঙ্গা-পদ্মা পানি বণ্টন চুক্তি পর্যালোচনা এবং নদীসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকার ১১ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল পাঁচ দিনের সফরে সোমবার ভারতের কলকাতায় পৌঁছায়।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যৌথ নদী কমিশনের তত্ত্বাবধানে বিশেষজ্ঞ কমিটির ৮৬তম বৈঠকের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা সোমবার (৩ মার্চ) দুপুরেই কলকাতা থেকে ফারাক্কা বাঁধ পরিদর্শনে সেখানে গিয়েছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নয়াদিল্লি থেকে আসা দেশটির কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। দুই প্রতিনিধিদলে কারিগরি বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা-দিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্কের বর্তমান শীতল সময়ে যৌথ নদী কমিশনের এ বৈঠক ঘিরে দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।
দুই দেশের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে, গত বছর ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নিলে ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক গত ৫৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্বাভাবিক হয়। ঠিক তার আগে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে উষ্ণতম।
বলা হচ্ছে, গত সাত মাসে সীমান্ত হত্যা, সীমান্তে উত্তেজনা, শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে শুধু দোষারোপই নয়, সীমান্তে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়াসহ উত্তপ্ত পরিস্থিতির ঘটনাও ঘটেছে। একাধিকবার দুই দেশের কূটনীতিককে সতর্ক করার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর আগস্ট থেকে বাংলাদেশিদের জন্য ভারত ভ্রমণভিসাসহ অন্যান্য ভিসা বন্ধ করেছে। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসাসহ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে স্বল্প আকারে ভিসা চালু করে দিল্লি। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে কোনো আলোচনা বা সমাধান আসেনি। এর মধ্যে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে। তাতেও কোনো পক্ষই আলোচনার টেবিলে বসেনি।
তবে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকেই ইতিবাচক মনোভাবের কথা বলা হচ্ছে। ফলে ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের এ বৈঠক ঘিরে কূটনৈতিক সম্পর্কের শীতলতা কাটার একটা ইঙ্গিত বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
যদিও ভারতীয় গণমাধ্যমে দেশটির সরকারের বরাতে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, যেকোনো কারণেই হোক দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যকার পাঁচ দিনের এ বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একই অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে দিল্লির সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্যে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিল্লির সরকারি কর্মকর্তারা মনে করে— বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকার নয়, তাই তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো আলোচনাতে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। অর্থাৎ তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সঙ্গে এমন কোনো সমঝোতায় যাবে না, যেখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্ন আছে।
এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা মনে করে, গঙ্গা চুক্তি নিয়ে দুই দেশের যৌথ কমিটি মুখোমুখি বৈঠকে বসছে এবং সরেজমিনে ফারাক্কা ব্যারাজ পরিদর্শন করতে পারছে, এটা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
বলা হচ্ছে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবুজ সংকেতের পরই এ বৈঠকের প্রস্তুতি নেওয়া হয় এবং বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
এ বৈঠকের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তির ৩০ বছরের মেয়াদ ২০২৬-এর ডিসেম্বরেই শেষ হবে— ফলে কোন শর্তে চুক্তিটির নবায়ন করা হবে, সেটি স্থির করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ওই চুক্তির নবায়নের জন্য মাত্র বছর দেড়েকের মতো সময় হাতে আছে বলেই এ বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠকটিকে স্থগিত করতে চায়নি কোনো পক্ষই, দুই দেশের কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা যাচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যম বলেছে, এটি এমনিতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের রুটিন বৈঠক হলেও যেহেতু গঙ্গা চুক্তির নবায়নের সময় এগিয়ে আসছে, তাই এটির আলাদা গুরুত্ব আছে। এখানে টেকনিক্যাল কমিটির বিশেষজ্ঞরা বৈঠকে বসছেন। কারণ আমাদের হাতে চুক্তি নবায়নের জন্য হাতে খুব বেশি সময় নেই।
ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, যেহেতু ঢাকায় বর্তমান সরকারের সঙ্গে দিল্লি কোনো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বা সমঝোতায় যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই তিস্তা নিয়ে আলোচনা না এগোলেও গঙ্গা নিয়ে বৈঠক কিন্তু ঠিকই হচ্ছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের যেকোনো বৈঠকই গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটি রুটিন বৈঠক। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দিল্লিকেও ভূমিকা রাখতে হবে।
৫ দিনের বৈঠকে কী থাকছে : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার যৌথ নদী কমিশনের অন্যতম সদস্য মুহাম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল গঙ্গা চুক্তি নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিতে সোমবার সকালে কলকাতায় যায়। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিদল ফারাক্কা ব্যারেজ পরিদর্শনে যায়। দুইদিন (সোম ও মঙ্গলবার) ফারাক্কা ব্যারাজের বিভিন্ন অংশে যৌথ পরিদর্শন হবে।
বুধবার যৌথ কমিটির সদস্যরা আবার কলকাতায় ফিরবেন। বৃহস্পতি ও শুক্রবার কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে গঙ্গা চুক্তি নিয়ে দুই দেশের ‘টেকনিক্যাল কমিটি’র বিশেষজ্ঞদের বৈঠক। পরদিন শনিবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ঢাকায় ফিরবে। দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা পর্যায়ক্রমিকভাবে ভারতে গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধের পয়েন্টে ও বাংলাদেশে পদ্মার ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ও অন্যান্য বিষয় যৌথভাবে সরেজমিনে খতিয়ে দেখবে বলে জানা গেছে।
গঙ্গা ও পদ্মার পানি বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ অভিযোগ করেছে, শুষ্ক মৌসুমে ফরাক্কা বাঁধ থেকে তারা পর্যাপ্ত পানি পায় না। ভারতীয় পক্ষের দাবি, পানি প্রবাহের স্বাভাবিক উঠানামার কারণে কিছু সময় পানির পরিমাণ কমবেশি হয়। এ সফর ও বৈঠকে সেই বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হবে বলেও কূটনৈতিক সূত্রগুলো দাবি করেছে।
গঙ্গা ও পদ্মা পানি চুক্তি : ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা-পদ্মা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই হিসেবে ৩০ বছর মেয়াদি সেই চুক্তির পুনর্নবীকরণ হওয়ার কথা আগামী বছরের মধ্যে।
গত বছর জুন মাসে দুই দেশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, চুক্তি পুনর্নবীকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটি আলোচনা শুরু করবে। ফারাক্কা পরিদর্শনের পর বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুদিনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক হবে এবং চুক্তি পুনর্নবীকরণের আলোচনা হবে।
অভিন্ন, সীমান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী এবং আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো নিয়ে সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশন ১৯৭২ সালে একটি দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়া হিসেবে গঠিত হয়েছিল।
এদিকে গঙ্গা পানি চুক্তি পুনর্নবীকরণে রাজ্য সরকারকে বাদ দিয়ে একতরফা আলোচনার বিরোধিতায় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টনের নীতিমালার কথা উল্লেখ করেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পশ্চিমবঙ্গের জনগণের জীবিকা নির্বাহের জন্য এর বিশাল প্রভাব রয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয়, তা কলকাতা বন্দরের নাব্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com