আয়নাঘর থেকে মুক্ত জীবনে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত গোপন বন্দিশালায় শুধু রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও ভিন্নমতাবলম্বীরাই বন্দি ছিলেন, তা নয়। সেখানে বন্দি ছিলেন পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনও। তাকে দুবছর আয়নাঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্যদের মতো সুব্রত বাইনকেও গোপন এ বন্দিশালা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঢাকার অপরাধ জগৎসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দুবছর আগে ভারতের জেলখানা থেকে ছাড়া পায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। এরপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপনে পুশব্যাকের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালত হয়ে কারাগারে পাঠানোর কথা। কিন্তু সুব্রত বাইনকে সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোপন বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ এই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরতে তার মাথার ওপর ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তাকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম এই সুব্রত বাইন।
গত ৫ আগস্টের পর একে একে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী। এ তালিকায় রয়েছেÑ সানজিদুল হাসান ইমন, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, ফ্রিডম সোহেল, আরমান, হাবিবুর রহমান তাজ। হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও কেউ কেউ দেশে ফিরে আসে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় হঠাৎ দেখা মেলে ৯০ দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপানো মগবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ত্রিমতি সুব্রত বাইনের।
ভারতের কারাগারে বন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত কী করে হঠাৎ বাংলাদেশে এলো, এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে আমাদের সময়। অনুসন্ধানকালে আমাদের সময় তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়, সুব্রত বাইন দুবছর ধরে বন্দি ছিলেন গোপন বন্দিশালায়। এই তিন ব্যক্তি সুব্রত বাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদেরকেই বলেছেন বাংলাদেশে ফিরে আসা এবং গত বছরের ৫ আগস্টের পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্তির গল্প।
সুব্রত বাইন তাদের জানিয়েছেন, ৬ আগস্ট তাকে গোপন বন্দিশালা থেকে বের করে চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে তোলা হয়। এরপর ঢাকার বাইরে গাজীপুরের একটি জঙ্গলের ভেতর ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সরাসরি মগবাজারে আসেন সুব্রত। চেহারায় বড় পরিবর্তন ও মুখে দাঁড়ি থাকার কারণে প্রথমে তাকে কেউ চিনতে পারেনি। এরপর পরিচয় দেওয়ার পর সবাই অবাক হয়ে যান। খবর পেয়ে তার কাছে ছুটে আসে সহযোগীরা। এরপর সেখান থেকে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে যান সুব্রত। সেখানে কয়েকদিন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। বর্তমানে এই শীর্ষ সন্ত্রাসী ঢাকাতেই আত্মগোপন করে আছেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তিনি দেখা করেছেন। তারা সবাই তাকে নীরব থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সুব্রত বাইন বসে নেই।
নব্বইয়ের দশকে মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে সুব্রত বাইনের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের উত্থান ঘটে। চলে দখলবাজিও। তখন থাকতেন নয়াটোলা আমবাগানে। একপর্যায়ে তিনি হয়ে ওঠেন মূর্তমান এক আতঙ্ক। মগবাজারে সুব্রত বাইন ছাড়াও তৌহিদুজ্জামান টিক্কা ও মোল্লা মাসুদের পৃথক বাহিনী তৎপর ছিল। পরবর্তীকালে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানও হয়ে ওঠেন আতঙ্কের কারণ। ২০০১ সালের দিকে পল্লবীর কালাপানি থেকে টিক্কাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে হাসপাতালে থাকাকালে প্রতিপক্ষ লিয়াকত গ্রুপ তাকে বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে মেরে ফেলে বলে অভিযোগ ওঠেছিল। সে সময় লিয়াকতের ডান হাত ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান। এই আরমানও ৫ আগস্টের পর কারামুক্ত হয়েছে।
এদিকে ২০০১ সালে ঢাকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হলে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ ভারতে পালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে দুজনই গ্রেপ্তার হয়। সুব্রত বাইন কলকাতার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পালিয়ে চলে যায় নেপালে। সেখানে গিয়ে আবার ধরা পড়ে। এরপর সুড়ঙ্গ করে নেপাল কারাগার থেকে পালিয়ে সুব্রত বাইন আবার কলকাতায় চলে আসে। সেখানে আবারও ধরা পড়ে। সেই থেকে কলকাতার কারাগারেই ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে ফেরত আনতে কূটনৈতিক চ্যানেলে একাধিকবার যোগাযোগ করে সরকার। এরপর দুবছর আগে সুব্রত বাইনকে গোপনে ফেরত পাঠানো হয়। তবে মোল্লা মাসুদ বর্তমানে কোথায় আছে, তা জানা যায়নি।
এদিকে গোপন বন্দিশালা থেকে সুব্রত বাইন ছাড়া পাওয়ার পর ফের চাঁদাবাজি শুরু করেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আসছে। মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে আবার বাহিনী গড়ে ওঠেছে তার। তাকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, যেসব অপরাধী অপরাধ করছে তাদের আমরা ছাড় দিচ্ছি না। আপনি জানেন এলিফেন্ট রোড মাল্টিপ্ল্যানে সন্ত্রাসী ঘটনার পর আমরা ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে।
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত গুম কমিশনে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি অভিযোগ। অভিযোগের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে।
কমিশন রিপোর্ট বলেছে, র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনের সব বন্দোবস্ত ছিল। বন্দিশালাগুলোয় নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে ছিল সাউন্ড প্রুফ কক্ষ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ডিজাইন করা বিভিন্ন যন্ত্র। গুমের পর অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন।
গত ৫ আগস্টের পর গোপন বন্দিশালা বা আয়নাঘর থেকে ছাড়া পেয়ে অনেকেই সেখানকার অমানবিক নির্যাতনের গল্প তুলে ধরেন। এ ব্যাপারে তারা এবং যারা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন তাদের পরিবার গুম কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেন। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে গুম কমিশনের সদস্য, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন আমাদের সময়কে বলেন, এ বিষয়টি তার জানা নেই। এ ব্যাপারে তিনি গুম কমিশনের অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন।
তথ্য বলছে, গোপন বন্দিশালায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকেও নির্যাতন করা হয়েছে। ঠিকমতো তাকে খেতে দেওয়া হতো না।
পুলিশের সাবেক ডিআইজি মাজেদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, টোটকা চিকিৎসা দিয়ে সব সময় রোগের উপশম হয় না। কখনও কখনও তা রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে। যে অপরাধীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ রয়েছে তাকে তো বিচারের মুখোমুখি করতে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার কথা। তা না করে গোবন্দিশালায় আটকানো হলো। এটা তো আইনসম্মত হলো না।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || news@banglaralo24.com || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || ads@banglaralo24.com
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com