প্রস্তুত হচ্ছে নির্বাচনী মাঠ
অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম যখন চলছে, অন্যদিকে তখন যাত্রা শুরু করেছে নির্বাচনী ট্রেনও। নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইতোমধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে উচ্চ আদালতে ত্রয়োদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের শুনানিও চলছে। সব মিলিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার বলেছেন, নির্বাচনের লক্ষ্যে ট্রেন ইতোমধ্যেই প্রথম স্টেশন ছেড়েছে; একটি নতুন নির্বাচন কমিশন সাধারণ নির্বাচনের জন্য মাঠ প্রস্তুত করবে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরই দেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কারে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ পুলিশ-প্রশাসনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। সংস্কারের অংশ হিসেবে দশটি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী জানুয়ারির শুরুতেই এসব কমিশন তাদের সুপারিশ দাখিল করবে সরকারের কাছে। এমনটাই জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এসব কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ মাঠপর্যায়ে সক্রিয় প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল। তবে জামায়াত অবশ্য বরাবরই বর্তমান সরকারকে দেশ সংস্কারে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলে আসছে। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও দাবি, নির্বাচনের আগেই প্রয়োজনীয় সব সংস্কার সম্পন্ন করার।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিগত সরকারের সময় পাস করা আইনের আলোকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার অবসরপ্রাপ্ত সচিব এএমএম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। নতুন এই নির্বাচন কমিশনই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পরির্বতনের এক মাসের মাথায় গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। এরপর দেড় মাস কমিশন-শূন্য ছিল ইসি সচিবালয়। ফলে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম থমকে ছিল। নতুন কমিশন শপথ নিয়ে প্রথমেই তারা প্রতি বছরের মতো হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রস্তুতের অনুমোদন দেবেন। পাশাপাশি সরকারের পরামর্শক্রমে নির্বাচন আয়োজনে সার্বিক প্রস্তুতি নেবেন।
এই সরকার কত দিন থাকবে, কবে নির্বাচন হবে- এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারে বর্তমান সরকারের মেয়াদ ‘চার বছর’-এর কাছাকাছি বলে প্রচার হয়। কিন্তু গতকাল দেশীয় একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমি এটাকে অস্পষ্ট রাখার চেষ্টা করছি। কারণ মেয়াদ বলে দিলে তখন বলবে যে তাড়াতাড়ি এটা শেষ করেন। আমরা চাইছি সংস্কারটা যেন হয়। এটার জন্যই আমাদের সব চেষ্টা।
নির্বাচনের রোডম্যাপ ও সংস্কার প্রসঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, আমরা সমান্তরালভাবে দুটো রাস্তায় চলছি। সমান দৃষ্টিভঙ্গি ও সমান প্রচেষ্টা- দুটোর পেছনেই থাকবে। একটি সংস্কারের রাস্তা। আরেকটি হলো নির্বাচনের রাস্তা, যার সঙ্গে সংস্কারের কোনো সম্পর্ক নেই। কমিশন তার মতো চলবে। সেটা তো আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সেখানে যা যা দরকার সেটা হবে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসে গত মঙ্গলবার মানবাধিকার সংগঠন ‘ভয়েস ফর বাংলাদেশ’ আয়োজিত সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি কাক্সিক্ষত ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে।
এদিকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করেছিল বিএনপি। ২০১১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয় আপিল বিভাগ। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বৈধতা নিয়ে সুশাসনের জন্য
নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। বিএনপিসহ আরও কয়েকটি পক্ষ সেই রিটে ইন্টারভেনর হয়েছে। উচ্চ আদালতে রিটের শুনানি চলছে। শুনানি শেষে আগামী মাসে রায় হতে পারে। রিটের সঙ্গে যুক্ত বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল আমাদের সময়কে বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পলাতক শেখ হাসিনা সংবিধানকে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বানিয়েছিলেন। সেটি বাতিল করতে বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের মানুষের কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা রিটে ইন্টারভেনর হয়েছি।
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল আরও বলেন, উচ্চ আদালত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করলে সংবিধান আগের জায়গায় যাবে। সেক্ষেত্রে ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের একটি রায় আছে। সেই রায়ের রিভিউ শুনানি চলছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরাতে সেই রিভিউর রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
নতুন কমিশনে যারা আছেন
অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। এ কমিশনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে থাকছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি এই পাঁচজনকে বেছে নেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গতকাল বৃহস্পতিবার পৃথক প্রজ্ঞাপনে তাদের নাম প্রকাশ করে।
নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে অফিশিয়াল রিঅ্যাকশন দেওয়া যাবে। এ দায়িত্ব যখন এসেছে, আমাদের সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা নিয়ে। তিনি আরও বলেন, ১৮ বছর ধরে ভোটাধিকারের জন্য যুদ্ধ করার মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ‘শহীদ ও আহতদের’ রক্তের সঙ্গে নতুন নির্বাচন কমিশন বেইমানি করবে না। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই তিনি নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
৭১ বছর বয়সী নাসির উদ্দীন বলেন, একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশনের জন্য যা যা করা দরকার, আমরা তা করব ইনশা আল্লাহ।
নাসির উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন। এরপর ১৯৭৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষক হিসেবে। দুই বছর পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তথ্য সচিব, জ্বালানি সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অবসরে যান ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম অবসরে যাওয়ার আগে দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে। ২০১৬ সালে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদায় তাকে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। তার আগে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তাহমিদা আহমেদ ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই বছরই তিনি প্রথমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং পরে পাট অধিদপ্তরের পরিচালক হন।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। বিগত সরকার ২০২০ সালে তাকে মিনিস্টার পদের কূটনৈতিক পদমর্যাদায় এ পদে নিয়োগ দেন। ১৮তম বিএমএ লং কোর্সের এ সেনা কর্মকর্তা ৩৫ বছর মিলিটারি সার্ভিসে ছিলেন।
জানা গেছে, সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেবেন নতুন কমিশনের সদস্যরা। তবে শপথের তারিখ এখনও জানানো হয়নি।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com